• ঢাকা বুধবার
    ০১ মে, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও কি অস্থির হয়ে উঠছে বিশ্ব জ্বালানি তেলের বাজার?

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০২৪, ১১:৪৯ পিএম

আবারও কি অস্থির হয়ে উঠছে বিশ্ব জ্বালানি তেলের বাজার?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর প্রভাব জ্বালানি তেলের ওপর পড়লে বিশ্ব বাজারে বড় রকমের অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।

ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসনের ইতিহাস পুরনো হলেও গত বছর অক্টোবরে ইসরাইলের মাটিতে হামাসের অতর্কিত হামলা এই দুই ভূখণ্ডের সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই সংঘাতের জের ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের গণহত্যা চলার মধ্যেই ইরানের সঙ্গে আবার দ্বন্দ্বে জড়ালো ইহুদি রাষ্ট্রটি।

মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো দ্বন্দ্বের সরাসরি প্রভাব পড়ে জ্বালানি তেলের ওপর, যা ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে বেশ ভালোভাবে টের পেয়েছিল ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্ররা। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দেয়ার প্রতিবাদে সে সময়ের সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ এবং মিশরের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আনোয়ার আল-সাদাত পশ্চিমে তেল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল। এতে তখন বিশ্ব বাজারে তেলের দাম এত বেড়ে গিয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ভিত এক রকমের নড়বড়ে পরিস্থিতির মুখে পড়েছিল।

ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, যুক্তরাষ্ট্রের হয়েছে সেই দশা। মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো সংঘাতে সবার আগে পশ্চিমাদের শঙ্কা জাগে জ্বালানি তেল নিয়ে, যার ব্যত্যয় ঘটেনি এবারও।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান-ইসরাইল সংঘাতের কারণে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দামে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এতে করে তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানি তেলের বাজার কেমন হবে এবং আদৌ তেলের দাম বাড়বে কিনা সেটি অনেকাংশে নির্ভর করছে ইরানের ড্রোন হামলার পর ইসরাইল কী জবাব দেয় সেটির ওপর। ওপেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ ইরান। যদি ইরানের ওপর আঘাত আসে তাহলে তেল সরবরাহে বড় ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি হবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বিশ্ব বাজারে।

বিশেষ করে ইরান ও ওমানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া হরমুজ প্রণালী যেটি বিশ্বের তেল সরবরাহের প্রধান রুটের মধ্যে অন্যতম সেটি ক্ষতির সম্মুখীন হলে জ্বালানি তেলের বাজার বড় রকমের ধাক্কা খাবে। এই এক প্রণালী থেকে বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশ হয়ে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরান-ইসরাইল স্থায়ী সংঘাতে জড়ালে হরমুজ প্রণালীর আক্রান্তের আশঙ্কা অনেক।

সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওপেক সদস্য সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাকের সিংহভাগ তেলের সরবরাহ রুট এই হরমুজ প্রণালী। বিশ্ব বাজারে তেল সরবরাহের ২০ শতাংশ এ প্রণালী মারফত হয়ে থাকে। হরমুজ আক্রান্ত হলে জ্বালানি তেলের বাজারে বড় রকমের সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে।

সংঘাত স্থায়ী হলে বা আরও খারাপের দিকে মোড় নিলে তেলের দাম বেড়ে কত হতে পারে এমন প্রসঙ্গে লিপো অয়েল অ্যাসোসিয়েটসের সভাপতি অ্যান্ডি লিপো বলেন, ইরানের ওপর ইসরাইল পাল্টা আক্রমণ চালালে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যদি কোনো কারণে হরমুজ প্রণালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাতে করে তেলের দাম বেড়ে ১২০-১৩০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ৯০ ডলারের আশপাশে ওঠানামা করছে। ধারণা করা হচ্ছে, সংঘাতের সামান্য ফুলকিতে এক লাফে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে।

তেল-গ্যাস সংক্রান্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বিসন ইন্টারেস্টের পোর্টফোলিও ম্যানেজার জোশ ইয়াং তেলের দাম নিয়ে পূর্বাভাস জানিয়ে বলেন, একদিকে কমছে তেল-গ্যাসে বিনিয়োগের পরিমাণ, অন্যদিকে বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের সংখ্যা। নেতিবাচক এই দুই কারণে বিশ্ব জ্বালানি বাজার বড় রকমের সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। যদি বিনিয়োগ না বাড়ানো হয় এবং মধ্যপ্রাচ্য এসব সংঘাত থেকে নিজেদের বিরত রাখতে না পারে তাহলে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামসের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধকে ইরানের প্রক্সি ওয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে ইসরাইলের হামলা এবং এর প্রত্যুত্তরে ইরানের ড্রোন হামলা প্রক্সি ওয়ারকে সম্মুখ যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।

ইসরাইল এবং পশ্চিমাদের মতে ইরান হামাসের পাশাপাশি লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুথি সংগঠনগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে থাকে। মূলত ইসরাইল বিনাশের পরিকল্পনা হিসেবে ইরান বহুদিন ধরে এ ধরনের সংগঠনে মদদ জুগিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের হামলার প্রতিবাদ ও ইসরাইলের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজেদের সুদৃঢ় অবস্থানের কথা জানালেও সরাসরি কোনো যুদ্ধে ইসরাইলকে সাহায্য করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজকে যুক্তরাষ্ট্রের এক সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসরাইলের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শতভাগ সহায়তা দিলেও এ মুহূর্তে ইসরাইল যদি ইরান আক্রমণ করে বসে তাহলে সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই অংশ নেবে না। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের প্রতি এই অনীহার পেছনে বড় একটি কারণ দেশটির অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জিং অবস্থা, যার সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

২০০৮ সালের জুলাই মাসের পর রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বড় রকমের জ্বালানি সংকটে পড়ে পশ্চিমারা। রুশ পশ্চিমাদের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার জোরে ২০২২ সালের মার্চের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ১৪০ ডলার কাছাকাছি উঠে যায়। এতে করে পশ্চিমা বিশ্বে যে মূল্যস্ফীতির ধকল গেছে যার ফলাফল এখন অবধি তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসাব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে ২০২২ সালের মার্চ মাসের ১৭ তারিখ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভকে মোট ১১ বার সুদের হার বাড়াতে হয়েছে। এতে করে দেশটিতে এক বছরে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ সুদের হার বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। মূলত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ধকলই যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করেন দেশটির অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্ব না, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে এশীয় দেশগুলোর ওপর। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ আগে থেকেই মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পর্যদুস্থ তাদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, ইরান-ইসরাইল সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এমন শঙ্কায় এখন থেকে বিকল্প জ্বালানির বাজার খুঁজছে বাংলাদেশ।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইরান-ইসরাইল সংঘাতে যেকোনো জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হলে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। মূলত হুট করে যুদ্ধ শুরু না হওয়ায় যুদ্ধভাবাপন্ন পরিস্থিতির মধ্যে যুদ্ধের বাজারে টিকে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাকি দেশগুলো।

এক রকমের ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ইসরাইলে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে করে আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে ছিল ইহুদি রাষ্ট্রটি। তবে আক্রমণের আগে এই ঢাক-ঢোলের প্রভাবে ১২ এপ্রিল তেলের দাম বেড়ে ব্যারলপ্রতি ৯২ ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু আক্রমণের পর তেলের দাম ৯০ ডলারের নিচে নেমে আসে।

কেন ইরানের আক্রমণের পরেও তেলের দাম বাড়ছে না সে ব্যাপারে এ মুহূর্তে বিভিন্ন পক্ষ থেকে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। একদল জ্বালানি বিশ্লেষক বলছেন, এটি ঝড়ের আগে থমথমে অবস্থা। কোনো কারণে ইসরাইল ইরানে আক্রমণ করলে হু হু করে তেলের দাম বাড়তে শুরু করবে।

অনেকে আবার বলছেন, যেহেতু ইরানের আক্রমণে ইসরাইলে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। যেখানে দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে ইসরাইল এক রকমে নিজেদের প্রতিশোধস্পৃহা পূর্ণ করতে পেরেছে সেখানে ইরানের এই মামুলি পদক্ষেপের এখনই কোনো জবাব দেবে না ইসরাইল।

ইসরাইল কী করবে তার জন্য যেমন অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত কোনো উপায় নেই, একইভাবে জ্বালানি তেলের দাম কোনদিকে যাবে সেটির জন্যও এখন দেশ দুটির পরবর্তী পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ