• ঢাকা শুক্রবার
    ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ‘হ’ আদ্যাক্ষরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন লেনদেন

আলেশা মার্টের ঘটনায় লাভবান কারা?

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২২, ০৮:২২ পিএম

আলেশা মার্টের ঘটনায় লাভবান কারা?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

আলেশা মার্টের বহু প্রতারণার গল্প নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হলেও এ ঘটনায় কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বরং কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গোপনে আর্থিক লেনদেনের তথ্য জানা গেছে। তদন্তসংশ্লিষ্টদের নজরদারি করা এক কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সদস্যের কাছে এ সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য রয়েছে।

দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আলেশা মার্টের প্রধান মঞ্জুরুল আলম শিকদারের একনিষ্ঠ দুই ব্যক্তিকে গোপনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে আলেশা মার্টের সঙ্গে পুলিশ সুপার মর্যাদার এক কর্মকর্তার আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কাজ করে উপ-পরিদর্শক পর্যায়ের দুই পুলিশ সদস্যকে নিয়েও পাওয়া গেছে বেশ কিছু তথ্য। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

গোয়েন্টা সংস্থার সূত্রটি আরও জানায়, বিভিন্ন সময় পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়ে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। আগেও তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্যকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে।

সূত্রটি জানায়, এ ক্ষেত্রে প্রথমে যে কাজটি করা হয় তা হলো-সুস্পষ্ট তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্ত সদস্যের বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি। এরই ফলশ্রুতিতে আলেশা মার্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে এমন চার থেকে পাঁচ কর্মকর্তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই আলেশা মার্টের কাছ থেকে সুবিধাভোগী বলে চিহ্নিত হয়েছে।

আর সবই করা হয়েছে মাঠপর্যায়ের উপ-পরিদর্শক মর্যাদার দুই কর্মকর্তার মাধ্যমে। আবার কোথাও কোথাও সরাসরি সংযুক্ত থাকার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। রয়েছে একটি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার আর্থিক লেনদেনের তথ্যও। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে।

একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘হ’ আদ্যাক্ষরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলেশা মার্ট প্রধানের সম্পর্ক বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। উপযুক্ত সময় এবং উপযুক্ত প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য প্রমাণ করা হতে পারে।

আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুরুল আলম শিকদারের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়ার জন্য অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছিল। যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর তাই এ বিষয়ে জানার জন্য তাকে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। এমনকি তার অফিস এবং বাসভবনে যান এই প্রতিবেদক। কিন্তু কোনোভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা বা কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ কারণে তার বক্তব্য ছাড়াই সংবাদটি প্রকাশে বাধ্য হয়েছে সিটি নিউজ ঢাকা।

এই লেনদেনের বিষয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুরুল আলম শিকদার। অতি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে এক গোপন বৈঠকে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘তদন্তসংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিতে দিতে আমি পেরেশান। প্রতি মাসে কোনো না কোনো অজুহাতে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। ইনিয়েবিনিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ দুই হাত তিন হাত ঘুরিয়ে এই ঘুষের টাকা নিচ্ছেন।’

মঞ্জুরুল আলম আরও বলেন, ‘তদন্তকারীরা এখন পর্যন্ত যত টাকা নিয়ে গেছে, এই টাকা দিয়ে প্রতারিত গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করা যেত। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, এতে তার দেশে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ চায় আমি দেশে থেকে এভাবেই তাদের বড় দাগের মাসোহারা দেই ।’

এসব কারণ দেখিয়ে আলেশা মার্ট প্রধান জানান, আলেশা মার্ট এখন যে অবস্থানে রয়েছে সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের কেনাকাটার জন্য প্রথম পছন্দ ই-কমার্স প্লাটফর্ম। ডিজিটাল প্রতারণার গণ্ডি পেরিয়ে ধীরে ধীরে দেশের আধুনিক জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল এই খাতটি। ঠিক এমন সময় আবির্ভাব ঘটে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে চটকদার ও লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর কিছু পণ্যের ডেলিভারি দিয়ে জিতে নেয় গ্রাহকদের আস্থা। তারপর বের হয়ে আসে প্রতিষ্ঠান প্রধান মঞ্জুরুল আলম শিকদারের আসল রূপ। শুরু হয় প্রতারণা।

আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলমের পরিকল্পনায় গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় শত শত কোটি টাকা। বন্ধ করা হয় পণ্য সরবরাহ। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর বন্ধ করা হয় দাফতরিক কার্যক্রম।

বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন প্রতারিত গ্রাহকরা। শুরু হয় আন্দোলন। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে আলেশা মার্টের প্রধান কার্যালয়ে সাত ঘণ্টা আটকে রাখা হয় আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলমকে। দীর্ঘ সময় আটকে রাখায় অসুস্থ হয়ে পড়েন মঞ্জুরুল আলম শিকদার। পরে রাত ৯টার দিকে বনানী থানা-পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। নড়েচড়ে বসে প্রশাসনসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতারণার অভিযোগে শুরু হয় তদন্ত।

এরপর প্রতারণার ওপর প্রতারণা শুরু করেন মঞ্জুরুল আলম শিকদার! প্রতারিত গ্রাহকদের পাওনা অর্থ ফেরতের নাম করে নিজেদের লোকদের দিয়ে অর্থ প্রাপ্তির কথা বলে দেয়া হয় ফেসবুকে পোস্ট। যেখানে দেখা যায়- একই নাম্বারের টাকা এবং বান্ডিল দেয়া হয়েছে একাধিক জনকে। এ ছাড়া টাকা প্রাপ্তির পোস্ট দেয়া অধিকাংশ আইডিই ফেক বলেও প্রমাণিত হয়।

শুধু তাই নয়, আলেশা মার্ট অভিনব কায়দায় ক্রেতার তথ্য সংগ্রহ করে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে। আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানের বহু তথ্য এখনও অজানা থেকে গেছে। একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা তার ব্যাপারে যে ধরনের তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে যা পিলে চমকানোর মতো। হয়তো এ কারণেই আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম পালিয়ে যাবার নিরাপদ রুট খুঁজছেন।

 

এআরআই/এএল

আর্কাইভ