• ঢাকা শুক্রবার
    ১৭ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

৬১ কোটি লোকসানের বোঝা নিয়ে চালু হচ্ছে কেরু চিনিকল

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩, ১২:৪৪ এএম

৬১ কোটি লোকসানের বোঝা নিয়ে চালু হচ্ছে কেরু চিনিকল

ছবি: সংগৃহীত

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

৬১ কোটি ৫ লাখ টাকা লোকসানের বোঝা নিয়ে ২০২৩-২৪ আখ মাড়াই মওসুম শুরু করতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় চিনিকল চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। মাড়াই মওসুম সফল করতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ।

১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বড় চিনিকল দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। চিনি উৎপাদন কারখানা, ডিস্টিলারি, জৈব সার কারখানা ও ওষুধ কারাখানার সমন্বয়ে গঠিত বৃহৎ এ শিল্প কমপ্লেক্সে চিনি কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনে আসছিল। সরকারিভাবে চিনির মূল্য বৃদ্ধির কারণে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে চিনিকারখানাটি। এ ছাড়াও প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে মিলস হাউসে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে চিনিকলটি আধুনিকায়নের কাজ চলছে। এতে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়বে। তবে এলাকায় আখ চাষ ক্রমাগত কমতে থাকায় সংকটে পড়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই চিনিকলটি।

শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেলে চিনিকলের কেইন কেরিয়ারে আখ নিক্ষেপের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এবারের মাড়াই মওসুম উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান শেখ শোয়েবুল আলম। সবকিছু ঠিকঠাক চললে চিনিতে মোটা অঙ্কের লোকসান কমিয়ে আনতে পারবে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি এমনটিই আশা করছে কর্তৃপক্ষ।

৬৫ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবারের মাড়াই মওসুমে। মোট ৫৫ মাড়াই দিবসের লক্ষ্যমাত্রায় চিনি আহরনের গড় হার ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এ উপলক্ষে কেরু চিনিকলে আনুষ্ঠানিকতার সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন। এদিন বিকাল চারটার সময় মিলের ক্যান কেরিয়ার প্রাঙ্গণে সংক্ষিপ্ত সভা ও দোয়া মাহফিল শেষে ক্যান কেরিয়ারে আখের আঁটি নিক্ষেপের মাধ্যমে চলতি ২০২৩-২৪ মাড়াই মওসুমের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান শেখ শোয়েবুল আলম এনডিসি। এ সময় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কেরু চিনিকলের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ও কর্মচারী ফেডারেশনের নেতারাসহ আখচাষি ও সুধিজন উপস্থিত ছিলেন।

চিনিকলের শ্রমিকরা জানান, এ বছর মিলস হাউসের ফিটিংয়ের কাজ ভালো হয়েছে। মিল ভালোই চলবে। ফলে বেশি চিনি উৎপাদন সম্ভব হবে। কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘মাড়াই মওসুম শুরু করতে চিনিকলের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে চিনিকল এলাকায় আখের চাষ কম হয়েছে। এ জন্য এবছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে এ মওসুমে লোকসান কমিয়ে আনতে সবাই মিলে কাজ করছে।’

এ মওসুমে ৫৩ মাড়াই দিবসে প্রতিদিন গড়ে ১১শ ৫০ টন আখ মাড়াই করবে চিনিকলটি। ৬১ হাজার ৫০০ হাজার টন আখ মাড়াই করে শতকরা ৬ দশমিক ২ ভাগ চিনি আহরণের মাধ্যমে ৩ হাজার ৮শ ১০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

গত বছর ২০২২-২৩ মাড়াই মওসুমে ৪২ মাড়াই দিবসে প্রায় ২৩ হাজার টন চিনি উৎপাদন করেছিল চিনিকলটি। সে সময় আখের অভাবে র্নিধারিত দিনের আগেই বন্ধ হয়ে যায় চিনিকল। এ বছর কেরু চিনিকল জোনে দণ্ডায়মান আখ রয়েছে ৩ হাজার ৮০২ একর জমিতে। এর মধ্যে চিনিকলের নিজস্ব জমিতে আখ রয়েছে ১ হাজার ১৫৩ একর জমিতে।

চাষিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ মওসুমে আখের মূল্য বাড়িয়েছে সরকার। এবার প্রতি মণ (৪০ কেজি) আখের মূল্য ২২০ টাকা টাকা করা হয়েছে। তবে চিনির শূল্য বাড়লেও আশানুরূপ হারে আখের মূল্য বাড়েনি। আখের মূল্য আরও বাড়ানোর দাবি চাষিদের।

বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সহসভাপতি মো. ওমর আলী বলেন, চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে আখচাষিদের এবার দাবি, চাষিদের মাঝে আখ বিক্রির পুজির পরিমাণ বাড়াতে। আখের মূল্য সরাসরি নগদে পরিশোধ করতে। শিওর ক্যাশ বা বিকাশে চাষিরা টাকা নেবে না। ঋণের সার, বীজ, কীটনাশক সঠিক সময়ে দিতে হবে এবং চাষিদের কোটায় পাওনা চিনি উত্তোলনের সময় বাড়াতে হবে।’

১৮০৫ সালে মি. জন ম্যাকসওয়েল নামক এক ইংরেজ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় ভারতের কানপুরে জাগমু নামকস্থানে তখনকার একমাত্র ফরেন লিকার কারখানাটি চালু করেছিলেন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে এর নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মি. রবার্ট রাসেল কেরু অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হন এবং কালক্রমে তা ক্রয় করে নেন। উত্তর ভারতের ‘রোজা’-তে অবস্থানকালীন ১৮৫৭ সনে সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতঃপর তা পুনঃনির্মাণপূর্বক জয়েন্ট স্কট কোম্পানি গঠন করে ‘কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লি. হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয়। ‘রোজা’-তে ব্যবসা উন্নতি লাভ করলে আসানসোল ও কাটনিতে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সনে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১০০০ টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষ্যে আরও একটি শাখা তদানীন্তন নদীয়া জেলার অন্তর্গত এ দর্শনায় স্থাপন করা হয়। ১৯৬৮ সনে ইংরেজরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (পাকিস্তান) লি. এর স্থলে ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব ইপিআইডিসির ওপর ন্যস্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি এটি কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লি. নামে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রনাধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব খাতে জমা দিয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। যা প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

 

 

জেকেএস/

আর্কাইভ