
প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৫, ০৭:৩৪ পিএম
ভাঙচুর আর আগুনে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে সাতটি পরিবার। খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের। আগুনে পুড়ে গেছে ঘরের সব চাউল। জ¦লছে না চুলা। রোববার দুপুরে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার বৃদ্ধ মরিচ গ্রামে।
পাবনার ভাঙ্গুড়ায় নৈশপ্রহরী হত্যায় জড়িত সন্দেহে সাতটি পরিবারের দশটি ঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ উঠেছে। দুই সপ্তাহ ধরে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো। খেয়ে না খেয়ে কাটছে তাদের দিন। ইতিমধ্যে হত্যায় জড়িত দুই আসামি ও ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের মামলায় তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, শুধুমাত্র সন্দেহের জেরে সাতটি পরিবারকে নিঃস্ব করার দায় কে নেবে?
গত রোববার (২২ জুন) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘরগুলো পড়ে আছে ভাঙচুর অবস্থায়। মাঝে কিছু সিমেন্ট ও বাঁশের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। পুড়ে যাওয়র ক্ষতচিহ্ন ভাঙা ঘরের বারান্দা জুড়ে। ধ্বংসস্তুপ দেখে মনে হবে যেন বসতবাড়িগুলোর উপর দিয়ে ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেছে। স্থানীয় একটি মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে সাতটি পরিবারের উপর চালানো হয়েছে এই বর্বরতা। সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর। এমন চিত্র পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার বৃদ্ধ মরিচ গ্রামের।
ক্ষতিগ্রস্থরা জানান, ১০ জুন সকাল নয়টা। সকালের রান্না করে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সবাই। এমন সময় স্থানীয় ১০ থেকে ১২ জন বিভিন্ন বয়সী লোক এসে কোনো কথা না বলে অতর্কিত তাদের উপর হামলা চালায়। মারধর করে মহিলাদের বের করে দিয়ে একে একে সাতটি পরিবারের দশটি ঘরে ভাঙচুর লুটপাট চালায়। শেষে আগুন দিয়ে চলে যায়। ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভায়। ততক্ষণে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
ভুক্তভোগী পরিবার ও মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ৯ জুন রাতে চন্ডিপুর সিকেবি আলিম মাদরাসার নৈশপ্রহরী ওসমান গণি মোল্লা (৬২) কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি কাজীপাড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন। নিহত ওসমান গণি উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের মৃত রিয়াজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে। ওইরাতে বৃদ্ধমরিচ গ্রামের মৃত বদরুজ্জামানের ছেলে শাহাদত হোসেন ভালবাসার সম্পর্কে এক মেয়েকে নিয়ে ওসমান গণি মোল্লার কাছে গিয়ে তাদের বিয়ে পড়াতে বলেন। কিন্তু শাহাদতের স্ত্রী-সন্তান থাকায় বিয়ে পড়াতে রাজী হননি তিনি। পরে ওই রাতেই খুন হন ওসমান গণি।
১০ জুন সকালে হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে শাহাদতকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় স্থানীয় গ্রাম্য প্রধানরা। এরপর মসজিদে মাইকিং করে তার বাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার আহবান জানান স্থানীয় বাসিন্দা সাইদুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণ পর শাহাদতের বাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে উত্তেজিত এলাকাবাসী। শাহাদতসহ তার ছয় ভাই ও এক বোনের মোট সাতটি পরিবারের দশটি ঘর ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তার আগে ঘরে থাকা সকল আসবাবপত্র, নগদ টাকা, চাউল, ফসল, স্বর্নালঙ্কার, গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়।
তবে এ হত্যাকণ্ডের পর ওসমান গণি হত্যায় জড়িত মুল দুই অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করে পুলিশ। পরে তারা ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বাীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিও দেয় যে মাদকের টাকার জন্য তারা বৃদ্ধকে খুন করেছে। তারা হলো, বৃদ্ধ মরিচ গ্রামের জেলহক প্রামানিকের ছেলে হাবিব (১৪) ও চন্ডিপুর গ্রামের আসমত আলীর ছেলে আহমদ উল্লাহ (১৫)। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে আব্দুল বারিক বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে ১০ জুন ভাঙ্গুড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে ১১ জুন দুই কিশোরকে আটকের পর ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরে সন্দেহভাজন আটক শাহাদতকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
এছাড়া ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্থরা হলেন, বৃদ্ধ মরিচ গ্রামের মৃত বদিউজ্জামান সরকারের ছেলে রবিউল করিম, আব্দুর রহিম, নুরুল ইসলাম, আব্দুস সোবাহান, সাদ্দাম হোসেন, শাহাদত হোসেন ও লাইলী খাতুন। এদের মধ্যে নুরুল, সোবাহান ও সাদ্দাম মালয়েশিয়া প্রবাসী। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষে বড় ভাই রবিউল করিম বাদি হয়ে গত ১৮ জুন মামলা করেন। মামলায় ১৩ জনকে নামীয় ও ৩০ থেকে ৩৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলার পর পুলিশ ১৯ জুন তিন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। তারা হলেন, চন্ডিপুর গ্রামের মৃত আবু তাহেরের ছেলে সাইদুর রহমান, বৃদ্ধ মরিচ গ্রামের আব্দুল জব্বারের ছেলে আনোয়ার হোসেন ও সাইফুল ইসলামের ছেলে শাহীন হোসেন।
ক্ষতিগ্রস্থ আব্দুর রহিমের স্ত্রী সাবিনা খাতুন বলেন, ‘সকালে কেবল রান্না করে উঠেছি। খাইওনি। এমন সময় সাইদুর রহমান মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয় শাহাদতের বাড়ি ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দাও। তখনি প্রথমে ১০ থেকে ১২ জন এসে হামলা করে। একদিকে ভাঙচুর করে অন্যদিকে ঘরে যা ছিল সব লুটপাট করে। আসবাবপত্র, টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, চাউল, ফসল এমনকি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী পর্যন্ত লুট করে নিয়ে গেছে।’
রবিউল করিম বলেন, ‘সেদিন এক কাপড়ে সবাই বাড়ি থেকে কোনোমতে প্রাণ বাঁচাতে পারলেও, আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব ধ্বংস করে লুটপাট করে নিয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে গত দুই সপ্তাহ ধরে আমরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছি। এ ঘটনায় আমাদের প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হত্যা করলো কে আর তার সন্দেহে আমাদের এত বড় ক্ষতি করলো মানুষ। এখন এর দায়ভার কে নেবে।’
লাইলী খাতুন বলেন, ‘আমার ছোট ভাই শাহাদত কে জড়িত সন্দেহ করে আমাদের উপর বর্বর হামলা করেছে। পরে তো ঠিকই আসল আসামি ধরা পড়লো। প্রমাণ হলো আমার ভাই জড়িত নয়। তাহলে এখন আমাদের কি হবে। কে দেবে এই ক্ষতিপূরণ। তাই আমরা ক্ষতিপূরণ ও জড়িতদের শাস্তি চাই।’
ক্ষতিগ্রস্থ নুরুল ইসলামের স্ত্রী খাদিজা খাতুন বলেন, ‘আমরা এখন বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে একরাত একরাত করে কাটাচ্ছি। দিনের বেলায় এসে ভাঙাঘরের সামনে এসে বসে থাকি। কেউ কিছু দিলে খাচ্ছি। না দিলে না খাচ্ছি। প্রশাসন থেকে যেটুকু সহযোগিতা দিয়েছে তা দিয়ে কি হবে বলেন। আমরা এখন কিভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাবো। এখন সরকার, প্রশাসন, সমাজের বিত্তবানরা যদি সহযোগিতা করে তবেই আমরা বাঁচবো।’
এ বিষয়ে ভাঙ্গুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, ‘নৈশপ্রহরী ওসমান গণি হত্যার মুল দুই আসামি হাবিব ও আহমদ উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। মাদকের টাকার জন্য মুলত ওসমান গণিকে খুন করেছে বলে তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিও দিয়েছে। পরে শাহাদতকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের মামলায় সাইদুর রহমানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।’
ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ নাজমুন নাহার বলেন, ‘হামলার পর ক্ষতিগ্রস্থদের শুকনো খাবার, এক বাণ্ডিল করে টিন, নগদ ৬ হাজার করে টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে। এই অর্থবছর যেহেতু শেষ, তাই সামনের অর্থবছরে আবারও তাদের সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে।’
এদিকে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন অসহায় ক্ষতিগ্রস্থ এসব পরিবার। সহযোগিতা পাঠানোর জন্য রবিউল করিম ০১৭৩৬-৬৭৭২১০ এই নাম্বারে যোগাযোগের অনুরোধ জানানো হয়েছে।