• ঢাকা শুক্রবার
    ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাজে না ঘন্টা ডাকহরকরার

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২২, ১১:২৬ পিএম

বাজে না ঘন্টা ডাকহরকরার

থেমেছে এখন ডাকহরকরার ঘণ্টা

মু আ কুদ্দুস

ধুলোয় পড়ে থাকা ডাকবাক্সের কথা মনে আছে? ডাকবাক্সটি ছিল সাক্ষাৎ কোনো এক দেবদূত! সেখানে চিঠি ফেলতে মানুষ আসত দূর-দূরান্ত থেকে! সেই কষ্টে ছিল আশা, ছিল স্বপ্ন। কত আশা সেই চিঠিকে ঘিরে? একটি চিঠি একটি স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার! আর সেই ডাকবাক্সটি ছিল একটি জাদুর কলস! প্রতিদিন সেই বাক্স থেকে বেরোত ভালো-মন্দের খবর। আশা-ভরসার বার্তা। আসত স্বপ্ন পূরণের চিঠি। সব রঙিন স্বপ্নগুলো সেই কলসে বন্দি হয়ে থাকত। মনে হতো এই তো সেই বাক্স, যার মাধ্যমে আমি চোখের পলকে উড়ে যেতে পারব দেশ থেকে দেশান্তরে!

আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার ডাকহরকরা। এদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট ও দায়িত্ববোধের গল্প উঠে এসেছে গল্প ও কবিতায়। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দিন কাটে এদের প্রতিদিন প্রতিমাস।

তাদের জীবন ছিল অনেক কষ্টের। হাজারো মানুষের ‘আশা’ থাকত তাদের চটের থলিতে। মানুষ চিঠির পাশাপাশি টাকাও পাঠাতেন প্রিয়জনের কাছে। সেই টাকা ও চিঠি পৌঁছে দিতেন গ্রামে গ্রামে। এক হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে বল্লম আর কাঁধে চিঠির বোঝা নিয়ে রাত-দিন ক্লান্তিহীন ছুটে চলতেন ডাকহরকরা। সূর্য ওঠার আগে আবার ফিরে আসত পোস্ট অফিসে। যত  দূরেই হোক যেতে হতো তাদের দূর বনগাঁয়ে।

ডাকহরকরা সেজে মিউজিক ভিডিওতে আরজু

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য থাকলে দেখতেন, চিঠির বোঝা এখন আর রানার বহন করে না। চিঠি লেখার প্রয়োজনও নেই। হয়তো একদিন লেখা হবে। কোনোদিন শত বছর আগে। মানুষ চিঠি লিখত। রানার মেইল ট্রেন থেকে চিঠির বোঝা নিয়ে ছুটত পোস্ট অফিসে। ডাকহরকরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিত প্রিয়জনের চিঠি। সুকান্ত লিখেছিলেন-

“রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে

রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে

রানার চলেছে, রানার!

রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।

দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার

কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।”

তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তার ‘ডাকহরকরা’ গল্পে লিখেছেন- “ডাক-হরকরা মৃত্যুতালে ছুটিতে ছুটিতে চলিয়াছে। এই গতি তাহাকে বার বার সমানভাবে বজায় রাখিয়া চলিতে হইবে। পথে এক দণ্ড বিশ্রাম করিবার উপায় নাই, গতি শিথিল করিবার উপায় নাই।”

একটা সময় ছিল, খাকি পোশাকের পিয়ন দরজায় কড়া নেড়ে উচ্চস্বরে বলতেন, চিঠি চিঠি....। তখন কে আগে চিঠি নেবে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হতো। সেই চিঠি নিয়ে কে আগে খুলবে, কে পড়বে আগে-চলত প্রতিযোগিতা। যে পড়তে জানত না সে অন্য গ্রামে শিক্ষিত লোকদের কাছে নিয়ে যেতেন পড়ে শোনানোর জন্যে।

ডাক পিয়নের কাঁধে এখন থাকে না খবরের বোঝা। কেউ অপেক্ষায় থাকে না প্রিয়জনের চিঠির। তবু গ্রাম-শহরে এখনও মাঝে-মধ্যে দেখা মেলে পিয়নের। সুখ-দুঃখের কথামালার ব্যক্তিগত চিঠি নয়, রেজিস্ট্রি চিঠি কিংবা পার্সেল তুলে দেন প্রাপকের হাতে। এটা খুবই সামান্য।

শহর পেরিয়ে এখন প্রত্যন্ত গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে প্রযুক্তি। ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে চিঠিকে।

এখন পোস্ট অফিসে মানুষের আনাগোনা নেই। কর্মচাঞ্চল্যতাও নেই। ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে পোস্ট অফিসের অস্তিত্ব। অনেকেই আগলে রেখেছেন পুরনো চিঠি। যেখানে তাদের আবেগ, অনুভূতি আর ভালোবাসা মিশে আছে। ভালো লাগা মন ছুঁয়ে আছে। সেই অতীত এখন ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়।

হয়তো ডাক পিয়নের হাতে চিঠি আসার দিন ফিরবে না। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও ই-মেইলের মতো উন্নত প্রযুক্তি গিলে খেয়েছে সেই চিত্র। হারিয়ে যাচ্ছে লেখার অভ্যাস। অপেক্ষার আবেগি মুহূর্ত।

ডাকবাক্স এখন ইনবক্সে

অথচ কিছুদিন আগেও এই চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ব্যবস্থায় ছিল পোস্ট অফিস। সেই সময় পোস্ট অফিসের সামনে দেখা যেত মানুষের উপচেপড়া ভিড়। হাতে লেখা পত্রগুলো পড়ে কখনও আনন্দে মুখে হাসি ফুটত, আবার কখনও চোখের পানি গড়িয়ে পড়ত। চিঠি পেলেই অনেকে কাঁদত। কেউ খুশি হতো-হতো আবেগাপ্লুত। কি যে সেই অদ্ভুত টান ছিল কালি ও কাগজে লেখা চিঠিতে। কোনোদিনই পুরাতন হবে না হৃদয়ের এই ভাষা। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে সেসব আনন্দ আজ ম্লান।

পরিকল্পিত উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বদলে যাচ্ছে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের তথ্য আদান-প্রদানের বৃহৎ মাধ্যম ডাকঘর। বদলে গেছে চিঠি আদান-প্রদানের প্রচলনও।

আজ সেই ডাকহরকরা নেই। লণ্ঠন হাতে দেখি না ছুটতে গ্রামের মেঠো পথে। বাজে না ঝুম ঝুম ঘণ্ঠা তার। সবকিছু আজ থেমে গেছে। থেমে গেছে ডাকহরকরার ঘণ্টা।

 

সাজেদ/ 

আর্কাইভ