• ঢাকা মঙ্গলবার
    ২১ মে, ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

আফগানিস্তানে তালেবান বিরোধী বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১, ০১:৪০ পিএম

আফগানিস্তানে তালেবান বিরোধী বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরে তালেবান বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এর মাঝেই জালালাবাদসহ পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি শহরে বিক্ষোভে অন্তত দু’জন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে রাজধানী কাবুলেও।

বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) ছিল আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। এ উপলক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে কাবুলের মিছিল হয়েছে। সেখানে তালেবান যোদ্ধারা গুলি না চালালেও দ্রুত তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তবে পূর্বাঞ্চলীয় শহর আসাদাবাদে স্বাধীনতা দিবসের এক জমায়েতে লোকজন জাতীয় পতাকা উড়ালে তালেবানরা গুলি চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের রয়টার্স জানিয়েছে।

জাতীয় পতাকা সরিয়ে সেখানে তালেবানের সাদা-কালো পতাকা উঠিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় এই বিক্ষোভের মাত্রা তেমন কিছু না হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু আফগান সোচ্চার হয়েছেন। পাশাপাশি, কাবুল থেকে পালিয়ে যাওয়া আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ তার গোপন আস্তানা থেকে জানিয়েছেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী তিনিই এখন আফগানিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক প্রেসিডেন্ট এবং তালেবানের সরকার মানবেন না।

এক সময় আফগানিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন সালেহ। তালেবানের বিরুদ্ধে জোট তৈরি করে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, তার সঙ্গে প্রয়াত তালেবান বিরোধী কিংবদন্তী তাজিক নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদ এবং সাবেক আফগান সেনা প্রধান ইয়াসিন জিয়া রয়েছেন।

টুইটারে এক পোস্টে আমরুল্লাহ সালেহ জাতীয় পতাকা নিয়ে এসব মিছিলের প্রতি তার সমর্থন জানিয়ে লিখেছেন, 'যারা জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষায় প্রতিবাদ করছে তাদের প্রতি স্যালুট।'

সালেহ এবং তার সহযোগীরা প্রয়াত আহমেদ শাহ মাসুদের দুর্গ হিসেবে পরিচিতি উত্তরের পাঞ্জশির উপত্যকায় আত্মগোপনে রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাবুলের উত্তরে জাতিগত তাজিক অধ্যুষিত দুর্গম এই জায়গাটি ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত বিরোধী এবং পরে ৯০ এর দেশকে তালেবান বিরোধী প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখনও অঞ্চলটি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে নেই।

ইসলামাবাদে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আমির রানা বলছেন আফগানিস্তানের বড় শহরগুলোতে তালেবান বিরোধী যে মনোভাব রয়েছে, গত দুদিনের জাতীয় পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ তারই প্রতিফলন।

পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব পিস স্টাডিজের পরিচালক মি. রানা বলেন 'তালেবান এত দ্রুত সব কব্জা করে নেবে তার জন্য শহুরে আফগানরা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বড় বড় শহরে প্রচুর আবেগ এবং ক্রোধ। ঘটনাচক্রে ১৯শে আগস্ট আফগান স্বাধীনতা দিবস। ফলে অনেকে তা চেপে রাখতে পারছে না।’

রানা আরও বলেন, ‘এই বিক্ষোভ কতটা ছড়াবে তা বলা মুশকিল। কারণ শক্তি এখন তালেবানের হাতে এবং কড়া হাতে এই ক্ষোভ দমনের চেষ্টা তারা করবে এবং করছেও। তবে জাতীয় পতাকা শহুরে আফগানদের জন্য আবেগের একটি ইস্যু এবং ভবিষ্যৎ আফগান সরকারকে এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভবিষ্যৎ সরকারে হামিদ কারজাই এবং ড. আব্দাল্লাহ আব্দাল্লাহ-এর মতো রাজনীতিকরা যদি জায়গা পান তাহলে শহরাঞ্চলে প্রবল তালেবান বিরোধিতা এবং তালেবানকে নিয়ে শঙ্কা কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।

এদিকে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন তালেবানের এখন যে শক্তি তাতে সালেহ বা তার হুমকিকে তাদের গুরুত্ব দেয়ার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া, ৯০ এর দশকে যখন পাঞ্জশির কেন্দ্র করে নর্দার্ন অ্যাল্যায়ান্স নামে তালেবান বিরোধী যে সামরিক জোট গড়ে উঠেছিল সে সময়ের সঙ্গে বর্তমানের বাস্তবতার অনেক ফারাক। সে সময় তালেবান বিরোধী নেতারা উত্তরের সীমান্ত পর্যন্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে লড়াইয়ের জন্য সরবরাহ পেতে তাদের অনেক সুবিধা হতো। কিন্তু এখন পাঞ্জশির উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও উত্তরের প্রধান প্রধান শহর এবং সীমান্ত এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। ওইসব এলাকার বহু জাতিগত তাজিক এবং উজবেক গোষ্ঠী নেতা কাবুলের সরকারের ব্যাপারে বিরক্ত হয়ে গত বছরগুলোতে তালেবানে যোগ দিয়েছেন।

তা ছাড়া সালেহ এবং তার সহযোগীদের হাত তেমন শক্তিশালী নয়। সাবেক আফগান কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, পাঞ্জশির উপত্যকায় তালেবান বিরোধী বড় জোর ২০০০ থেকে ২৫০০ যোদ্ধা আছে এবং তাদের হাতে সাধারণ হাল্কা রাইফেল ছাড়া তেমন কোনো অস্ত্র নেই।

পাশাপাশি, আহমেদ শাহ মাসুদের যে সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব বা গ্রহণযোগ্যতা ছিল আমরুল্লাহ সালেহ বা মি মাসুদের ছেলের তা নেই। বিভিন্ন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন এমন সব খবর বের হচ্ছে যে সালেহর সঙ্গে কোনো জোট তৈরির সম্ভাবনা অস্বীকার করেছেন আহমেদ মাসুদ। আমির রানা বলেন, সবেচেয়ে বড় কথা, এই মুহূর্তে আমরুল্লাহ সালেহ এর পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

রানা আরও বলেন, ‘পশ্চিমারা ছাড়াও প্রতিবেশী সবগুলো দেশ এখন তালেবানের বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে। তারা এখন মানবাধিকার, নারী অধিকার এবং সন্ত্রাস বন্ধ নিয়ে তালেবানের সঙ্গে দেন-দরবার করছে। এ সময় কোনো দেশই তালেবান বিরোধী কোনো তৎপরতা উস্কে দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইবে না।

এমনকি তালেবানের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসেবে পরিচিতি পাকিস্তানও তালেবানের ওপর চাপ দিচ্ছে সরকারে তালেবান ছাড়াও অন্য রাজনীতিক এবং পশতুন ছাড়া অন্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রাখতে হবে। এ সপ্তাহের প্রথম দিকে সাবেক নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের কয়েকজন শীর্ষ নেতা ইসলামাবাদ সফর করে গেছেন। পাকিস্তানের সরকার এবং সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা কাবুলে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে কথা বলেছেন।

রানা বলেন, ‘সাধারণ যে ধারণা পাকিস্তান তার উল্টোটা করছে। পাকিস্তান কাবুলে এমন কোনো সরকার চাইছে না যেখানে শুধু তালেবান থাকুক। কারণ, পাকিস্তান মনে করে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার না থাকলে আফগানিস্তানে দ্রুত আবারও অরাজকতা শুরু হবে। পাকিস্তান এ কারণে তালেবানকে কোনো স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে না। একটি দেশও দেয়নি।

পাকিস্তান ছাড়াও যে দেশগুলোর স্বীকৃতি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তালেবানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ – যেমন চীন, রাশিয়া, ইরান তুরস্ক- তারাও প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সরকারের জন্য তাদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।

আমরুল্লাহ সালেহর মতো তালেবান বিরোধী আফগান নেতা ভবিষ্যতে কতটা সুবিধা করতে পারবেন অথবা ৯০ দশকের মতো তালেবানের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ কোনো সামরিক প্রতিরোধ মাথাচাড়া দেবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করছে কাবুলে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে তালেবান কতটা ছাড় দেয় তার ওপর।

শামীম/সবুজ/নির্জন
আর্কাইভ