• ঢাকা শুক্রবার
    ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
রূপপুরের জ্বালানি হস্তান্তর

পুতিন ও মোদিকে ধন্যবাদ জানালেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২৩, ০১:১২ এএম

পুতিন ও মোদিকে ধন্যবাদ জানালেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

বাংলাদেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দুই নেতাকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পরমাণু শক্তিকে শান্তিপূর্ণ পথে ব্যবহার করবে বাংলাদেশ। এখানকার বিদ্যুৎ হবে সম্পূর্ণ পরিবেশ-বান্ধব।

গেল ২৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়া থেকে পাওয়া ইউরেনিয়াম কড়া নিরাপত্তায় রূপপুরে নিয়ে রাখা হয়েছে। আজ সেই ইউরেনিয়াম আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর হলো।

অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি ভার্চুয়াল যুক্ত ছিলেন আইএইএ ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল ম্যারিয়ানো গ্রসি।

অনুষ্ঠানে পুতিন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক গভীর। সামনের দিনগুলোতে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সস্পর্কের কথা তুলে ধরে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বহু পুরনো। সমতা ও সম্মান এই সম্পর্কের ভিত্তি।

রূপপুরের এ যৌথ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে সবসময় রাশিয়া পাশে থাকবে জানিয়ে পুতিন বলেন, ২০২৪ সালের প্ল্যান্টটির ১ম ইউনিট এবং ২০২৬ সালেই উৎপাদনে আসবে ২য় ইউনিট। সিডিউল অনুযায়ী শেষ হবে এর নির্মাণকাজ।

সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই উৎপাদনে যাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রাশিয়া থেকে আমদানি করা ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়ামসহ পরমাণু চুল্লির বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে এপ্রিল পর্যন্ত।

এরপর, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য ইউনিট-১ প্রস্তুত হবে।

ইউরেনিয়াম সাইটে পৌঁছালেও, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেনো এতো বিলম্ব- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক এবং পরমাণু বিজ্ঞানী ড. শৌকত আকবর জানালেন, এখনো বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি। অপারেশন করা হবে ডামি ফুয়েল দিয়েও। নির্মাণ থেকে অপারেশনাল স্টেজে রূপান্তরের এ সময়ে আপাতত সরকার বড় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছে না বলে জানান তিনি।

এই পরমাণু এ বিজ্ঞানী বলেন, এখানে সাবধানতার দিক থেকে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। রাশিয়ার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একযোগে কাজ করে এ প্ল্যান্ট পরিচালনার দায়িত্ব একসময় বাংলাদেশের পরমাণু যোদ্ধারাই নেবেন।

আশা করা হচ্ছে, আমদানি করা ফুয়েল দিয়ে প্ল্যান্টটির প্রথম ইউনিট যথাসময়ে চালু করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সমান্তরালে এগিয়ে চলেছে প্রকল্পটির দ্বিতীয় ইউনিটের কাজও।

যেভাবে শুরু স্বপ্ন দেখা

সেই ১৯৬১ সালে যখন প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের তখন সেটা স্বপ্নই ছিল। এখন এটি আর স্বপ্ন নয়; ৬২ বছরের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন এটা বাস্তব।

বিশ্বের মোট ১৯৩টি স্বাধীন দেশের মধ্যে পরমাণু সমৃদ্ধ দেশের সংখ্যা মাত্র ৩১টি। ৩২তম দেশ হিসেবে চলতি বছর বাংলাদেশ নাম লেখাল পরমাণু সমৃদ্ধ দেশের তালিকায়। ইউরেনিয়ামের মজুত যেখানে শক্তিমত্তা প্রমাণের হাতিয়ার, সেখানে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, সর্বপ্রথম ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে লক্ষ্যে ১৯৬২-৬৮ সাল অর্থাৎ এ ছয় বছরের মধ্যে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদীতীরবর্তী রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের যথার্থতা যাচাই করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউস, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণকাজ আংশিক শেষ করা হয়।

সে সময় রূপপুরে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা থাকলেও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এ প্রকল্প বাতিল করে দেন। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রকল্পের অগ্রগতি স্তিমিত হয়ে পড়ে।

১৯৭৭-১৯৮৬ পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া রূপপুরে ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন, যার ভিত্তিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্লান-২০০০ অনুমোদন করে।

কিন্তু সরকার বদল হলে ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত রূপপুর প্রকল্পের সব কাজ বন্ধ থাকে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম ছিল রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা। এ লক্ষ্যে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলি সম্পাদন’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলি ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৩ মে ২০০৯ তারিখে বংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান ফেডারেশনের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন (রোসাটোম)-এর মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।

পরের বছর প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একটি জাতীয় কমিটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ও ৮টি সাবগ্রুপ গঠন করা হয়। ১০ নভেম্বর ২০১০ তারিখে জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো বাংলাদেশ সফর করেন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে আইএইএ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো ২০১৭ সালের ৩ জুলাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি এ কেন্দ্র স্থাপনে সব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্পেন্ট ফুয়েল রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও রাশান ফেডারেশনের সঙ্গে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট সহযোগিতা চুক্তি সই হয়। সেদিন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পথে পা দেয় এবং দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ ক্লাবে পদার্পণ করে।

পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর এবং ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যথাক্রমে এই কেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লিপাত্র বা রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন। উভয় অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাবনার ঈশ্বরদীতে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।

এদিকে গত ২৮ সেপ্টেম্বর আকাশপথে রাশিয়া থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছায় পারমাণবিক জ্বালানি। এরপর বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তা সড়কপথে রূপপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনই জ্বালানি ব্যবহার করা হবে না, এটি মজুত করে রাখা হয়েছে রূপপুরে। এরপর বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সকালে পারমাণবিক জ্বালানির দ্বিতীয় চালান রাজধানীর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। সেই সঙ্গে বিকেলে রূপপুরের পারমাণবিক প্রকল্পের ইউরেনিয়াম বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করল রাশিয়া।

 

সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন

 

জেকেএস/

আর্কাইভ