প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২৫, ১০:৪২ এএম
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। ভারতীয় উগ্রপন্থিদের আক্রমণের কারণে দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের ভিসাসেবা সাময়িক বন্ধ এবং কলকাতা ও শিলিগুড়ির বাংলাদেশ মিশনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশ মিশনগুলো আক্রান্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে এসব ঘটনায় ঢাকার উদ্বেগ জানান পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম। ভারতের দিল্লি, কলকাতা এবং শিলিগুড়িতে বাংলাদেশ মিশনে উগ্রপন্থিদের আক্রমণ, সহিংস পরিস্থিতি এবং উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে প্রণয় ভার্মাকে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় তলব করা হয়। এ সময় ভারতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গভীর উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানালে ভারতের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিভিন্ন ঘটনায় এ নিয়ে অন্তত ছয়বার প্রতিবেশী দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হলো।
এদিকে, ভারতের দূতকে ঢাকায় তলবের পরপরই দিল্লি বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে গতকাল মঙ্গলবার তলব করে। এ নিয়ে গত ৯ দিনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে দুবার তলব করল ভারত।
‘ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়’ শীর্ষক এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২০ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও হাইকমিশনারের বাসভবনের বাইরে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা এবং গত ২২ ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে বাংলাদেশ ভিসাকেন্দ্রে বিভিন্ন উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর ভাঙচুরের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে ভারত সরকারের কাছে এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ভারতে বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন প্রাঙ্গণের বাইরে সংঘটিত সহিংস বিক্ষোভের বিষয়েও বাংলাদেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ এ ধরনের পরিকল্পিত সহিংসতা বা কূটনৈতিক স্থাপনার প্রতি হুমকিমূলক কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়। এসব কর্মকাণ্ড কেবল কূটনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তাই বিপন্ন করে না বরং পারস্পরিক সম্মান, শান্তি ও সহনশীলতার মূল্যবোধকেও ক্ষুণ্ন করে। এসব ঘটনার বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে ভারত সরকারের প্রতি বাংলাদেশ আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া, ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক কর্মী ও স্থাপনার মর্যাদা-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত সরকার তার আন্তর্জাতিক-কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসএম মাহাবুবুল আলম মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে গতকাল মঙ্গলবার তলব করে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গভীর উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানায়। এ সময় ভারতের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ আশা করে, এই প্রতিশ্রুতি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপে প্রতিফলিত হবে। ভারতে বাংলাদেশের কোন কোন মিশনে ভিসাসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে- জানতে চাইলে মাহাবুবুল আলম বলেন, নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয় বিবেচনায় নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনে ও আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ভিসাসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া শিলিগুড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশ ভিসা আবেদন কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২০ ডিসেম্বর ভারতের দিল্লির চাণক্যপুরীর কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে রাতে ২০ থেকে ২৫ জনের উগ্রবাদী একটি দল চার থেকে পাঁচটি গাড়িতে বাংলাদেশ হাউসের মূল ফটকের সামনে চলে আসে। এ সময় তারা বাংলাদেশবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। গত শনিবার রাত ৮টা ৩৫ থেকে ৮টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশ হাউসের সামনে অবস্থান করে। বাংলাদেশ হাউসের গেটের সামনে এসে বিক্ষোভকারীরা কিছুক্ষণ স্লোগান দিতে থাকে। তারা বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে কথা বলছিল। এ সময় ‘হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে হবে’, ‘হাইকমিশনারকে ধর’ বলে স্লোগান দেওয়া হয়। ‘অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র সেনার’ ব্যানারে বিক্ষোভকারীরা হাইকমিশনের সামনে স্লোগান দেওয়ার পর চলে যায়।
গত শনিবার রাতের এ ঘটনার পর ব্যাখ্যা দিয়ে ভারত গত রোববার দুপুরে একটি প্রেস নোট জারি করে। তবে গত রোববার বিকালেই বাংলাদেশ ভারতের প্রেস নোট প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেয়। গত সোমবার দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন থেকে সব ধরনের কনসুলার সেবা ও ভিসা দেওয়া সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত এসব সেবা বন্ধ থাকবে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠনের বিক্ষোভে গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দীপু চন্দ্র দাসকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা এবং তার মরদেহ পোড়ানোর প্রতিবাদে এ সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় এই সমাবেশ শুরু হয়। কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিচার দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিল। ডেপুটি হাইকমিশনের প্রায় ২০০ মিটার দূর পর্যন্ত মোট তিনটি ব্যারিকেড দিয়েছিল পুলিশ। সমাবেশ শুরুর কিছুক্ষণ পরই পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীরা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে, একপর্যায়ে প্রথম ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে বিক্ষোভকারীরা। এরপর দ্বিতীয় ব্যারিকেড পর্যন্ত তারা পৌঁছে যাওয়ার পর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। দূতাবাসের অন্তত ১০০ মিটার দূরে বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয় পুলিশ।
এর আগে গত সোমবার ভারতের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রধান শুভেন্দু অধিকারী কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে গিয়ে দলবল নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে হুমকি দেন, কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশন রাখতে দেবেন না। এ সময় বার্তা সংস্থা এএনআইকে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, দীপুকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আমরা বাংলাদেশ হাইকমিশনকে এখানে থাকতে দেব না। বাংলাদেশকে হাইকমিশন তালা মেরে (বন্ধ) দিতে হবে। আগামী ২৪ ডিসেম্বর সীমান্তে এক ঘণ্টার প্রতীকী অবরোধ হবে এবং ২৬ ডিসেম্বর আমরা আবারও এখনও জড়ো হব।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসাকেন্দ্র ভাঙচুর করেন হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠনের সদস্যরা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), হিন্দু জাগরণ মঞ্চ ও শিলিগুড়ি মহানগর সংগঠনের সদস্যরা গত সোমবার শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসাকেন্দ্রে ভাঙচুরের পর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়েক বছর ধরে ‘ডিইউডিজিটাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসাকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিষ্ঠানটি গত সোমবার বেলা ৩টার আগেই ভিসাকেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর পুনরায় ভিসাকেন্দ্র চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক টানাপড়েনের তলানিতে থাকা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার জি খোজিন গত সোমবার বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তেজনা হ্রাস করাটা জরুরি। এটি যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভালো। রাশিয়া বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে রাশিয়া মনে করে, দুই দেশের সম্পর্ক বর্তমানে যে স্তরে রয়েছে, সেখান থেকে উত্তেজনা যেন আর বাড়তে না পারে, সে জন্য একটি উপায় খুঁজে বের করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সম্পর্ক পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান দৈনিক বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার পর সম্পর্কের অবনতি হওয়া খুব খারাপ লক্ষণ। এটি শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয় বরং উদ্বেগজনক। এরকম চলতে থাকলে দু দেশে চরমপন্থিদের উল্লম্ফন ঘটবে এবং নির্বাচনে তার অশুভ প্রভাব পড়বে। ফলে, নির্বাচিত সরকার এলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপড়েন অব্যাহত থাকতে পারে। এ মুহূর্তে সম্পর্কের অবনতি রোধ প্রথম করণীয়। এ জন্য যারা দায়িত্বশীল তাদের দায় অনেক। অন্য পক্ষ কী করছে তার পাল্টা পদক্ষেপ কীভাবে নেওয়া যায় তা বিবেচনায় না নিয়ে বরং নিজ উদ্যোগে সম্পর্কের অবনতি কীভাবে রোধ করা যায় তাতে সচেষ্ট হতে হবে। আমি মনে করি, এখনও তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আলাপ-আলোচনার দ্বার খোলা আছে। কোনো নির্দিষ্ট দাবিতে স্থির থাকার সময় এখন নয় বরং এখন সর্বোচ্চ সদিচ্ছা প্রদর্শনের সময়। আমরা যেন উসকানিতে পা না দিই এবং উসকানিমূলক পরিস্থিতি তৈরি না করি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ বলেন, আমাদের এখানেও ওদের (ভারতের) মিশনে হামলা হয়েছে। ওদের ওখানেও আমাদের মিশনে হামলা হয়েছে। দুই জায়গায় এই হামলার ঘটনা কম-বেশি হতে পারে। তবে এর চেয়ে আর বেশি অস্থির হওয়ার কিছু নেই। এর চেয়ে বেশি হলে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ঢাকা-দিল্লি কেউই সেদিকে যাবে না। তবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ আমরা ছোট দেশ, সক্ষমতা কম। কিন্তু বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার গরজ দেখছি না। তবে সামনে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে সম্পর্ক আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবে।
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্রী রাধা দত্ত বলেন, দুই দেশের সম্পর্কে যা ঘটে গেছে এখন তা ভেবে লাভ নেই। এখন সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। প্রত্যাশা করি যে, উত্তেজনাকর ঘটনা আর ঘটবে না এবং পরিবর্তন আসবে।