• ঢাকা শুক্রবার
    ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিন ও কলকাতার কফি হাউজ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২২, ০২:৫৩ এএম

নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিন ও কলকাতার কফি হাউজ

আব্দুল বারী, ঢাকা

কি বা কে, কখন কিভাবে প্রতিষ্ঠা পায় তা প্রতিষ্ঠাতাও জানেন না। কালের বিবর্তনে অখ্যাত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও স্থান ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। সেই সাক্ষ্য বহন করছে কলকাতার কফি হাউজ ও নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিন।

নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিন, কলকাতার কফি হাউজেরও অনেক আগের প্রতিষ্ঠান। কফি হাউজ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪২ সালে। বোস কেবিন প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২১ সালে। ইন্ডিয়ান কফি বোর্ড ছিল কফি হাউজের উদ্যোক্তা। আর বোস কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নৃপেন চন্দ্র বসু (ভুলুবাবু)। তিনি ছিলেন বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামের বাসিন্দা।

কফি হাউজ: ১৯৪২ সালে ইন্ডিয়ান কফি বোর্ড বাঙালি কফি সেবীদের জন্য কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে একটি কফি হাউজ খোলে। এর কিছুদিন পরই কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হলে কফি হাউসটি খোলা হয়। ১৯৪৭ সালের পরও কফি হাউস ওখানেই থেকে যায়। ১৯৫৭ সালে কফি হাউসকে ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা মুক্ত করে শ্রমিক সমবায়ের আওতায় আসে।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ও অ্যালবার্ট হলের দুই কফি হাউসই ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রধান আড্ডাস্থল। নিকটতম বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের ভিড় করা ছাড়াও নামিদামী বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকদের আড্ডার জন্য প্রতিষ্ঠানটি ছিল অবারিত।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরনো বইয়ের বাজার ও নতুন বইয়ের বাজারের নৈকট্যের কারণেই কফি হাউসটিতে সব সময়েই ভিড় লেগে থাকতো। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, বাঙালি অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরাও সময় পেলেই ছুটে আসতেন ওই কফি হাউসটিতে। যুগের ভাটায় হাউসটি খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল।

এরপর বিখ্যাত শিল্পী মান্না দে’র কণ্ঠে প্রকাশ হলো সাড়া জাগানো সেই গান- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। এরপরই মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকলো ওই গান। এই গানটি জাতপাতের সকল গণ্ডি পেরিয়ে সব মানুষের প্রীয় হয়ে উঠলো। সেই থেকে আবারও প্রাণ ফিরে পেলো কলকাতার কফি হাউস। 

বোস কেবিন: অন্যদিকে ঢাকার অনতিদূরেই নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরের ২নং রেলগেট এলাকায় এই রেস্তোরাঁটির অবস্থান। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে রাজনৈতিক আন্দোলনে জাতীয় রাজনীতিবিদগণ ঐতিহ্যবাহী এই রেস্তোরাঁটিতে আড্ডা দিতেন। সেই থেকে এটি হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।

১৯২১ সালে নৃপেন চন্দ্র বসু (ভুলুবাবু) নারায়ণগঞ্জ শহরের ১নং ও ২নং রেলগেটের মধ্যবর্তী ফলপট্টি এলাকায় টংঘরে রেস্তোরাঁটি চালু করেছিলেন। প্রথমদিকে চা ও বিস্কুট নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আস্তে আস্তে সেটি রেস্তোরাঁতে রূপ নেয়। ১৯৮৮ সালে রেস্তোরাঁ চেম্বার রোডে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এর নাম ‘নিউ বোস কেবিন’।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কেবিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বেগবান করার জন্য আন্দোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন চিঠিপত্র বোস কেবিনের ঠিকানায় আসতো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সময় এই স্থানটি আরও বেশি প্রসিদ্ধতা পায়।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে বোস কেবিনে আড্ডা দিতেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও অবাঙালি রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ।

পানীয় হিসেবে পানির পরে চা এর স্থান। সেই চা বা কফির দোকান এক এলাকায় একই নামে শত বছর ধরে টিকে থাকবে তা হয়তো এই প্রতিষ্ঠান দুটির প্রতিষ্ঠাতারাও কোনো দিন ভাবেননি।

স্বাধীনতাপূর্ব কিছু মুক্তবুদ্ধি চর্চায় অগ্রণী তরুণ প্রজন্ম, রাজনীতিবিদ, উকিল, কবি, সাহিত্য-রসিক, বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনায় ‘বোস কেবিন’ লক্ষ্যণীয়ভাবে ভরে উঠেছিল। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার মালিক খসরু বললেন, রেললাইনের পাশে অবস্থিত ‍‍`বোস কেবিনে’ অনেক বিকেল-আড্ডায় যোগ দিয়েছি। মুক্তচিন্তার দেশপ্রেমীদের আড্ডাস্থল এই চা স্টলটি ব্রিটিশ আমলে পুলিশের নজরদারি মুক্ত ছিল না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।

 

আর্কাইভ