• ঢাকা বুধবার
    ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইজ্জত অর্থনীতি : এস এম আক্তারুজ্জামান

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২২, ০৭:৩১ পিএম

ইজ্জত অর্থনীতি : এস এম আক্তারুজ্জামান

সিটি নিউজ ডেস্ক

"হ্যালো, ডিআইজি আক্তারুজ্জামান বলছেন?"

ফোনে আমার নিজ এলাকা নারায়নগঞ্জের উচ্চারণে এবং টানে জিজ্ঞেস করছেন আমাকে। নিশ্চয়ই কাছের কেউ, যেহেতু নাম ধরে ডাকছেন।

"হ্যা, বলছি, বলেন কি সমস্যা?"

আমার এলাকার লোকজন থাকে ব্যবসা-বাণিজ্য আর জমি বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত। সরকারি চাকরি কম করে, সরকারি ক্ষমতার লাভ তেমন বুঝে না, তবে বিপদে পড়লে মাঝে মাঝে কাছের দুই-একজন ফোন দেন। তাই, এভাবেই উত্তর দিয়েছিলাম। এ ছাড়া রাত ১১টার মতো হয়েছিল।

"বাবা, আমাদের ইজ্জত শেষ, আমার মেয়েটিকে অমুকের ছেলে আজ কলেজ থেকে আসার পথে জোড় করে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। সারাদিন চেষ্টা করে খুইজা পাই নাই, থানায় আইছি, ওসিকে মামলা নিতে বইলা দাও। যত টাকা লাগুক, আমার মেয়েকে উদ্ধার কইরা দাও।’’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

কান্না কান্না কণ্ঠে আবেগে এবং রাগে বিস্ফোরিত হয়ে বলে যাচ্ছিলেন।

"দেখেন, আমার মনে হয় মেয়ে প্রেম করে পালিয়েছে। শান্ত হউন, পুলিশ চেষ্টা করবে।"

কিছুটা পরিচিত পুলিশের ভাষায় বলেছি। কারণ এই গল্প বা এপিসোড পুলিশের কাছে কমন। খুব কমন। কয়েকদিন পর উদ্ধার হয়ে আদালতে গিয়ে মেয়ে ভালোবাসার বক্তব্য দিবে বিয়ের কাগজ করে।

"নারে বাবা, আমার ইজ্জতের কি হবে? ওরা তো মুইন্নার গুষ্ঠি।"

তিনি সব টাকা খরচা করে মেয়েকে উদ্ধার করে ইজ্জত বাচাতে চান। এ খেত্রে মেয়ে নয় ইজ্জত বড়। অনেক টাকা কামিয়েছেন ইজ্জত কিনতে এবং রক্ষা করতে। প্রেম, প্রেম পলায়ন এটা আদিম। মেয়ে ভুল বা অপরাধ কর‍তেই পারে, এতে সবার ইজ্জতের কি সর্বনাশ হলো? হ্যা হলো, পাড়া প্রতিবেশী খোঁচা দিবে, ইজ্জত মারবে, সামাজিক মাধ্যমে আসবে, আজেবাজে মন্তব্য আসবে ইত্যাদি।

সমাজবিজ্ঞানী মাসলোর চাহিদার মই তত্ত্ব অনুসারে আমাদের দেশে ইজ্জত অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী। উনার তত্ত্ব অনুযায়ী অর্থনীতির প্রথম ধাপ হলো পেট অর্থনীতি, তারপর ভালোবাসা অর্থনীতি। এর পরে ৩য় ধাপে রয়েছে ইজ্জত অর্থনীতি। পেট অর্থনীতি সার্বজনীন কিন্তু আকারে বড় নয়। মানুষ সারাজীবনে কয় টাকা খায়? ধরেন, গড়ে ২৫ লাখ টাকা। অপরদিকে ভালোবাসা অর্থনীতির ক্লায়েন্ট আছে পেট অর্থনীতির ১০% , কিন্তু প্রতিজন ক্লায়েন্ট ভালোবেসে জীবনে গড়ে খরচ করে ২.৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে ইজ্জত অর্থনীতির গ্রাহক আছে ভালোবাসা অর্থনীতির চেয়ে বেশি, পেট অর্থনীতির ২০%। বাট ইজ্জত অর্থনীতির আয়তন আমাদের জিডিপির প্রায় ৫০ ভাগ হবে  আমার ধারণা।

ইজ্জতের মূল্য আমাদের দেশে অনেক বেশি। বিশাল সামাজিক সম্পদ। আমরা ইজ্জতকে অনেক মূল্য দেই, ভয় পাই। ইজ্জত বাড়ানোর জন্য পদ পদবি কিনি, তৈরি করি নিজের এবং রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচা করে। চাষা, মুইন্না নাম ঘোচাতে জমি-জমা বিক্রি করে বিদেশে যাই, রাস্তার পাশে দোকান দেই, ইজিবাইক, মটরসাইকেল কিনি। যাদের ইজ্জত বেশি তাদের প্রেসার হাই থাকে, ব্লাডে সুগার বেশি থাকে ইজ্জতের চিন্তায়। তাই, দেশি এই দুই রোগের এবং রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বড় বড় হাসপাতাল হচ্ছে, চিকিৎসা অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। চোর, ডাকাত, খারাপ লোকদের ইজ্জত কম। তাদের রোগ শোক কম, ইজ্জতের পেছনে তাদের খরচ করতে হয় না, আয় উন্নতি বেশি।

এমন দেখেছি, প্রবাসীর স্ত্রী ভুলক্রমে একান্ত জৈবিক চাহিদার আবেগে কোন দুষ্ট লোকের খপ্পরে পরে ইজ্জতের হুমকিতে লাখ কোটি টাকা এবং নিজের সব বিলিয়ে দিয়েছে। কারণ, তার একটি একান্ত ছবি বা কথা দুষ্ট লোক ধারণ করেছিল। অনেক মেয়ে আত্নহত্যাও করেন ইজ্জত বাচাতে। জাহান্নামে যাবেন তবুও ইজ্জত দিবেন না। কত মূল্য ইজ্জতের। কিন্তু, যাদের ইজ্জত নেই, তারা নিজেরাই তাদের একান্ত ছবি নেটে ছড়িয়ে দেয় গ্রাহক জোগার করার জন্য, ভিউ বাড়িয়ে পয়সা কামানোর জন্য।

ইজ্জত অর্থনীতি প্রকাশ পায় সামাজিক অসাম্যের দেশে। আমাদের সমাজে বৈষম্য অনেক গভীরভাবে প্রোথিত। আমরা গুণ বা দোষকে খুঁজি না, খুজি গুণী বা দোষীকে। উন্নত পাশ্চাত্যের লোকজন ইজ্জত বুঝে না, বুঝে অধিকার, তাদের ভোগ করার লিবার্টি। তাই তারা বিমানে চড়ে হাফপ্যান্ট আর ২ ডলারের স্যান্ডেল পরে। এ জন্য তাদের অর্থনীতি খুব স্লো বাট স্থির। ইজ্জত অর্থনীতি দ্রুত চলে বাট অস্থির, উঠানামা করে, একদল ইজ্জত কামাই করতে অস্থির থাকে, আরেক দল ইজ্জত মারার জন্য অস্থির থাকে। অভিনন্দন এই দুই দলকেই।

 

লেখক : এস এম আক্তারুজ্জামান, ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ

আর্কাইভ