• ঢাকা শনিবার
    ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সুপারির খোলে পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র করে আজ তিনি কারখনার মালিক

প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২৩, ০৬:২৪ পিএম

সুপারির খোলে পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র করে আজ তিনি কারখনার মালিক

পিরোজপুর প্রতিনিধি

‘বছর তিনেক আগে ভারতীয় একটি ইউটিউব সাইট থেকে এক ভিডিও দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম এ কাজে। গত ৩ বছরের চেষ্টার ফলাফল এ কারখানা। তবে এটি আরও বড় পরিসরে করার চিন্তা ছিল কিন্তু যিনি আমাকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করার কথা বলেছিলেন তিনি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন। তখন সেই ব্যক্তির হঠাৎ অসহযোগিতার কারণে প্রায় থেমে যাওয়া আমি সেদিনই নিজের যতটুকু ছিল তা দিয়ে এই কারখানা শুরু করেছিলাম।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পিরোজপুরের শিল্পাঞ্চল খ্যাত নেছারাবাদ উপজেলার বাসিন্দা আকরাম হোসেন উজ্জ্বল নামের এক ব্যক্তি। তিনি ‘এ আর ন্যাচালার প্লেট’ নামের একটি কারখানার মালিক। পাশাপাশি তিনি ইউপি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নেছারাবাদের স্থানীয় আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে। বিষয়টি জানতে পেরে পরিবেশবান্ধব এমন কাজে বিভিন্ন সহযোগিতার কথা জানালেন পিরোজপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পিরোজপুর জেলার অন্যতম নদী বেষ্টিত এক উপজেলা নেছারাবাদ। যার রয়েছে সুপারি চাষের জন্য সুনাম ও খ্যাত। কয়েকদিন আগেও যেখানে সুপারি গাছের খোল বন জঙ্গলে পড়ে থাকতো। ফেলে দেওয়া সুপারির সেই খোল থেকে ‘এ আর ন্যাচালার প্লেট’ কারখানা বর্তমানে তৈরি করছে থালা, বাটি, ট্রে, নাশতার প্লেটসহ নানা রকমের তৈজসপত্র। যেখানে ইতোমধ্যেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৮ জনের। বাজারে বিদ্যমান প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম ব্যবহার উপযোগী প্লেটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব এসব সামগ্রীর ব্যবহার শুরু হয়েছে পিরোজপুর, বরিশাল ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। কারখানা বলছে এটি অত্র অঞ্চলের জন্য একটি সম্ভবনাময় শিল্প। বাণিজ্যিকভাবে এটি আরও বড় করতে পারলে এলাকার অনেক মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। এই পণ্যে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন আকরাম। 

dhakapost

এদিকে সুপারির জন্য বিখ্যাত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলা। গোটা উপজেলায় রয়েছে সারি সারি সুপারি গাছ। এসব গাছ থেকে ঝরে পড়া সুপরির খোল বা বাইল বেশিরভাগই বাগানে পড়ে থাকে। কেউ কেউ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করেন। কিন্তু জেলার স্বরূপকাঠী উপজেলার মাহমুদকাঠি গ্রামে সেই সুপারি গাছের শুকনো খোল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশবান্ধব ওয়ানটাইম প্লেট তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আকরাম হোসেন উজ্জ্বল। তার কারখানায় সুপারি খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে থালা, বাটি, ট্রে, নাশতার প্লেট বর্তমানে যার প্রচুর চাহিদা রয়েছে ঢাকাসহ স্থানীয় পার্যায়ে।

কারখানার শ্রমিক অনিক রায় বলেন, আমাদের কারখানায় যা তৈরি করা হয় তার কাঁচামাল পরিবেশ থেকেই আসে। এটি তৈরিতে কোনো রাসায়নিক বা ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয় না। এই পণ্যগুলো ব্যবহার শেষে আবার প্রকৃতিতেই মিশে যায়। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক থাকে। যা প্রকৃতির জন্য অনেক উপকার বয়ে আনে।

নারী শ্রমিক হোসনেয়ারা বেগম বলেন, সুপারির খোল সংগ্রহের পর এটি রোদে শুকাতে হয়। পরে আমরা এটিকে ধুয়ে কেঁচি দিয়ে কেটে মেশিনে পাঠাই। সেখান থেকে বাটি-প্লেটসহ নানা কিছু তৈরি হয়। এটি তৈরির জন্য খুব বেশি পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না।

কারখানায় কর্মসংস্থান হওয়া স্থানীয় নারী শ্রমিক রোজিনা আক্তার বলেন, আমরা এই কারখানাটি এর আগে এলাকায় দেখিনি। এর আগে কোনো কাজ না থাকায় ঘরে বসে থাকতাম। কারখানাটি হওয়ায় আমাদের এখন ঘরে বসে থাকতে হয় না। এখানে এসে কাজ করছি। আগে খরচ চালানোর জন্য স্বামীর কাছ থেকে টাকা নিতে হতো, এখন নিজেই আয় করি। যার কারণে পরিবারেও কিছু টাকা দিতে পারছি।

dhakapost

এ আর ন্যাচালার প্লেট কারখানার মলিক উদ্যোক্তা আকরাম হোসেন উজ্জল সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, আমি ২ থেকে ৩ মাস হয়েছে এই কাজ শুরু করেছি। আলহামদুলিল্লাহ এ কাজে দেশ ও বহির্বিশ্বে ভালোই সাড়া পাচ্ছি। উৎপাদন ভালোভাবে করতে পারলে যেভাবে দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে তাতে এটি বিক্রির জন্য বেগ পেতে হবে না বলে আশা করছি। আমার এখানে ৫ টি পণ্য  তৈরি হচ্ছে। এলাকার জন্য বর্তমানে বড়টা ৮ টাকা, মাঝারিটা ৬ টাকা এবং ছোট ২টা আছে যা বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকায়। বাইরে গেলে একটু দাম বাড়বে। আমি ও আমার স্ত্রীসহ এখানে অভ্যন্তরীণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে ৫ জন। টেকনিশিয়ান দরকার হলে মাঝে মাঝে নিয়ে আসি। এছাড়া বাইরে সুপারির খোল কিনে সংগ্রহের কাজ করে আরও ৩/৪ জন। এটার ভবিষ্যত অনেক ভালো। শতভাগ পরিবেশবান্ধব এই পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়বে। কারণ এটা পরিবেশ থেকে উৎপাদন হয়ে পরিবেশেই মিলে যাবে। আমি মনে করি পরিবেশ থেকে পরিবেশকে বাঁচাই বলেই পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকবে। শক্ত এবং বেশ মজবুত এ পণ্যের বিকল্প নাই বললেই চলে। আমি এই পণ্য তৈরির মধ্যেমে দিন বদলের স্বপ্ন দেখি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-ব্যবস্থাপক মিলটন চন্দ্র বৈরাগী বলেন, উপকূলীয় জেলা হিসেবে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা একটি অন্যতম শিল্পাঞ্চল। যেখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুপারি গাছ। ওয়ান টাইম যে পণ্যগুলো সেখানে উৎপাদন হচ্ছে, তার কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এই সুপারির খোল। এটি জেলার জন্য একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এ বিষয়ে কাজ করার ব্যাপারে বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া তারা চাইলে আমাদের ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের এই ব্যবসার বাণিজ্যিকভাবে প্রসার সম্ভব।

এ বিষয়ে পিরোজপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান জানান, পিরোজপুরের নেছারাবাদে আকরাম হোসেন নামে এক ব্যক্তি সুপারির খোল থেকে পরিবেশ বান্ধব দৈনন্দিন তৈজসপত্র তৈরি করছেন। যার ফলে পরিবেশে কোনো প্রকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে না। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তার সাথে সার্বিকভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা সকল প্রকার সহযোগিতা তাকে করব। যাতে পরিবেশ বান্ধব এই পণ্যটি টিকে থাকে। নেছারাবাদের মত একটি পর্যটন এলাকায় এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। আশা করছি সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এই শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারবো।

 

বিএস/

আর্কাইভ