
প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২৫, ০৯:০৭ পিএম
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আদালতের রায় বাস্তবায়নের নামে কোনো রকম নোটিশ বা প্রস্তুতির সময় না দিয়েই উচ্ছেদ করা হয়েছে তিনটি পরিবারের দীর্ঘদিনের বসতভিটা। ঈদের ঠিক আগমুহূর্তে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন এসব পরিবারের সদস্যরা। রক্ষা করতে পারেননি ঘরের আসবাবপত্র, পোশাক, খাবার এমনকি স্কুলপড়ুয়া শিশুদের বইখাতাও।
উপজেলার রামজীবন ইউনিয়নের বাজারপাড়া এলাকায় সোমবার বিকেলে চালানো এ উচ্ছেদ অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় মৃত মুরাদ মিয়ার তিন ছেলে—রিপু মিয়া, অনু মিয়া ও মনু মিয়ার বসতবাড়ি। জমির দাবিদার হিসেবে আদালতের রায় হাতে নিয়ে মাঠে নামেন মৃত আব্দুর রশিদের সন্তানরা। প্রায় ৩৬ বছর আগে দায়ের হওয়া মামলায় সম্প্রতি আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন। সেই রায়ের বলেই উচ্ছেদ অভিযানটি পরিচালিত হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, উচ্ছেদ হওয়া বাড়িগুলোর জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ভাঙা টিন-কাঠ, পোড়া চুলা, উল্টে থাকা হাঁড়ি-পাতিল। শিশুর স্কুলব্যাগ মাটিতে পড়ে ভিজে গেছে, বইখাতাগুলো কাদায় মাখামাখি। কেউ ধ্বংসস্তূপের পাশে নির্বাক বসে আছে, কেউ আবার ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ঘরহারা পরিবারগুলো কেউ আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশীর বাড়িতে, কেউবা খোলা আকাশের নিচেই দিন কাটাচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ, মৌখিক জানানো বা প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ শুরু হয় উচ্ছেদ।
মনু মিয়ার স্ত্রী নার্গিস বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এত বছর ধরে থাকি এখানে। হঠাৎ করে কোনো কিছু না বলেই ঘরবাড়ি ভেঙে দিলো। কিছুই নিতে পারিনি—বাচ্চাদের জামাকাপড়, বইখাতা, খাবার—সবই শেষ। শুধু ঘর না, আমাদের ঈদের আনন্দও ওরা ভেঙে দিয়েছে।’
একই সুরে কথা বলেন অনু মিয়ার ছেলে জীম মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার দাদার আমল থেকে এখানে আছি। মামলা চলছে জানি, তবে রায় হয়েছে তা জানতাম না। কোনো নোটিশও পাইনি। আমরা চেয়েছিলাম অন্তত ঈদ পর্যন্ত থাকতে। কিন্তু সে সময়টুকুও দিল না কেউ। এখন কোথায় যাবো?’
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুরো উচ্ছেদ প্রক্রিয়াটি ছিল অপ্রত্যাশিত, অমানবিক ও সহানুভূতিশূন্য। তাদের মতে, দীর্ঘদিন বসবাসকারী পরিবারের প্রতি সামান্য মানবিকতা দেখানো হলেও এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। হঠাৎ করে এভাবে কোনো সুযোগ না দিয়েই তাদের উচ্ছেদ করা শুধু অমানবিকই নয়, সমাজের ন্যায়বিচারের মানদণ্ডকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাজারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোর্শেদ আলম বলেন, ‘মানুষ তো মানুষই। আদালতের রায় বাস্তবায়নের নামে যদি কাউকে এভাবে পথে বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কতটা মানবিক বিচার? এত বছর ধরে যাদের এখানে দেখছি, তাদের এভাবে উচ্ছেদ করা সত্যিই মর্মান্তিক।’
জমির দাবিদার হিলোন মিয়া বলেন, ‘এটা আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। দীর্ঘদিন অন্যরা দখলে রেখেছিল। প্রায় ৩৬ বছর ধরে মামলা চলার পর আদালতের রায়ে জমির মালিকানা আমরা পাই। সেই রায়ের ভিত্তিতে জমি বুঝে নিয়েছি।’
অভিযানের বিষয়ে গাইবান্ধা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট কমিশনার আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা উচ্ছেদের আগে এক ঘণ্টার সময় দিয়েছিলাম। তারা সেটা কাজে লাগায়নি। বাধ্য হয়ে জমির দখল বুঝিয়ে দিতে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আর এ ধরনের অভিযানে বাদী-বিবাদী কাউকে আলাদা করে নোটিশ দেওয়ার নিয়ম নেই।’