
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৫, ১২:০৯ এএম
আফগানিস্তানে প্রথম তালেবান সরকারকে (১৯৯৬-২০০১) স্বীকৃতি দেওয়া মাত্র তিনটি দেশের একটি ছিল পাকিস্তান। ইসলামাবাদ দাবি করে, পরবর্তী সময়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ও তারা তালেবানকে সহযোগিতা করেছে।
কিন্তু ২০২১ সালে বর্তমান তালেবান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ইসলামাবাদ বলে, আফগান প্রশাসন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) বা পাকিস্তানের তালেবান যোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। তবে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে কাবুল।
গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শনিবারের পৃথক দুটি ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এক সময়ের মিত্র দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত কেন? কীভাবে সংঘর্ষের সূচনা হলো? এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি কি ঘটতে পারে?
শনিবার রাতে দুই দেশের সীমান্তে যে সংঘাত হয়েছে তা নিকট অতীতের ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। রোববার তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেছেন, তাদের প্রতিশোধমূলক আক্রমণের মুখে পাকিস্তানের ৫৮ সেনা নিহত হয়েছেন। আর পাকিস্তান দাবি করেছে, তাদের ২৩ সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। বিপরীতে তালেবান ও সংশ্লিষ্ট ২০০ সন্ত্রাসীকে হত্যা করা হয়েছে।
তালেবান তাদের পক্ষ থেকে আক্রমণকে প্রতিশোধমূলক বলছে। যুক্তি দিচ্ছে, গত বৃহস্পতিবার রাজধানী কাবুল ও পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলা হয়। পাকিস্তান এই হামলা চালিয়েছে। শনিবার রাতে যেটির জবাব দিয়েছেন তালেবান সেনারা। যদিও বিমান হামলার অভিযোগ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি ইসলামাবাদ।
সবশেষ কী হয়েছে
শনিবার রাত ১০টার দিকে তালেবান সেনারা পাকিস্তান সীমান্তে আক্রমণ শুরু করে। এরপর একাধিক স্থানে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রেডিওতে জানানো হয়েছে, গোলাগুলি হয়েছে মূলত খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশের কয়েকটি এলাকায়।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আফগান গণমাধ্যম টোলো নিউজ রোববার জানিয়েছে, সীমান্তবর্তী কুনার প্রদেশের কয়েকটি এলাকায় ভারী অস্ত্র ও ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। এই প্রদেশে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত প্রায় ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই সীমান্তটি ব্রিটিশ উপনিবেশকালের ‘ডুরান্ড লাইন’ নামেও পরিচিত।
সংঘাতের নেপথ্যে
তালেবান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার আফগানিস্তান দুটি বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে। এর একটি কাবুলে, অন্যটি সীমান্তবর্তী পাকতিকা প্রদেশে। তালেবানের দাবি, পাকিস্তান এসব হামলা করে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করেছে।
ইসলামাবাদ তালেবানকে টিটিপির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখার আহ্বান জানিয়েছে। একজন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, বিমান হামলা চালানো হয়েছিল। কাবুলে একটি গাড়িতে থাকা টিটিপির নেতা ছিলেন তাদের লক্ষ্য। টিটিপির ওই নেতার নাম নূর ওয়ালি মেহসুদ। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন- আল জাজিরা তা যাচাই করে দেখতে পারেনি।
এক সময় পারস্পরিক নিরাপত্তা স্বার্থে গুরুত্ব দিয়েছে পাকিস্তান ও তালেবান। কিন্তু ইসলামাবাদ যখন থেকে তালেবানের বিরুদ্ধে টিটিপির নেতাদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে, তখন থেকেই সম্পর্ক বৈরী হয়েছে। সংগঠনটির হামলায় পাকিস্তানে বহু প্রাণও গেছে।
ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্রের (সিআরএএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে টিটিপির হামলায় অন্তত ২ হাজার ৪১৪ জন নিহত হয়েছেন। বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে পাকিস্তানের জন্য ২০২৫ সাল হবে অন্যতম প্রাণঘাতী বছর। ২০২৪ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৪৬ জন।
সশস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে মূলত ২০২২ সাল থেকে। ওই বছর ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ক্ষমতায় থাকাকালে ইমরান তালেবানের মধ্যস্থতায় টিটিপিকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছিলেন। পরে সে যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেলেও হামলার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। সম্প্রতি সম্পর্ক আরও অবনতি হয়েছে। কারণ, ইসলামাবাদ আফগানিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা বাড়িয়েছে। এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু টিটিপি যোদ্ধাদের ঘাঁটি বলে দাবি করা হচ্ছে।
উভয়পক্ষ যা বলছে
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আফগানিস্তানের শনিবারের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভি, তালেবানের হামলাকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে বলেছেন, তারা বেসামরিক লোকের ওপর গুলি ছুঁড়েছে। যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আফগানিস্তান রক্ত নিয়ে খেলা করছে।
অপরদিকে আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইনায়াতুল্লাহ খাওয়ারিজমি এক্সে দেওয়া পোস্টে লিখেন, আফগান ভূখণ্ডে পাকিস্তানের বিমান হামলার পাল্টা জবাব দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান যদি ফের আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের মতো কিছু করে তাহলে আরও কঠোরভাবে জবাব দেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যা বলছে
পাকিস্তান-আফগানিস্তানের এই সংঘাত; দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত বদলের আরেকটি উদাহরণ। ফলে এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি উভয় দেশকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা উভয় পক্ষের সংযম চাই। সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাতেও অবদান রাখবে।
সংযমের আহ্বান জানিয়েছে কাতার ও সৌদি আরব। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয় পক্ষকে সংলাপ ও কূটনৈতিক পন্থা বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি বর্তমানে ভারত সফর করছেন। তবে সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে নয়াদিল্লি এখনো কোনও মন্তব্য করেনি। ইসলামাবাদ তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখছে।
পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে?
পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আসিফ দুররানি। তিনি মনে করেন, এই সংঘাত বড় বা গুরুতর কিছুতে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, আফগানিস্তানের তুলনায় পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা অনেক বেশি।
আসিফ দুররানি আরও বলেন, পরিস্থিতি যতই সংকটময় হোক না কেন, কূটনীতির পথকে সবসময় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দুই দেশের সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান)। আফগান সরকার নিজেদের ভূখণ্ডে টিটিপির উপস্থিতির কথা স্বীকার করছে না। ফলে এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্কে উত্তেজনা থাকেই যাবে।