• ঢাকা সোমবার
    ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

যেভাবে ফাঁদে ফেলতেন আরজে নিরব!

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১, ০৮:২৬ পিএম

যেভাবে ফাঁদে ফেলতেন আরজে নিরব!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

মিডিয়ার সুপরিচিত মুখ হুমায়ূন কবির নিরব ওরফে আরজে নিরব। দীর্ঘ ১৫ বছর আরজে হিসেবে রেডিও টুডে, এবিসি রেডিও, রেডিও ধ্বনি, সিটি এফএমে কাজ করেছেন তিনি। সুন্দর করে কথা বলা বা বাচনিক দক্ষতার কারণে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়। এই দক্ষতাকে পুঁজি করে জীবনের প্রায় সব পর্যায়েই সফল হতে থাকেন তিনি। সুললিত কণ্ঠ ও প্রাণখোলা হাসিমাখা ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসে বিশ্বস্ততার ভিত্তি আরও পাকা করেন। 

এরই মধ্যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমকাণ্ডে উঠে এলো তার নাম। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব সেলস (কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) অফিসার পদে নিয়োজিত তিনি। তার কাজই ছিল সাধারণ মানুষদের আকৃষ্ট করা। কিউকম নিয়ে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও নানা প্রচারণা চালান তিনি।

গত ২৪ আগস্ট কিউকম নিয়ে একটি নিউজও শেয়ার দেন। সেখানে নিরব লিখেন, ‘পুরো দেশ আর সারা দুনিয়াজুড়ে কিউকম ছড়াতে চাই, ইনশাআল্লাহ ‘৮ বিভাগে নিজস্ব ডেলিভারি পয়েন্ট, ওয়ারহাউজ, কাস্টমার কেয়ার চালু করবে কিউকম- নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এমন অনেক স্ট্যাটাস আর নিউজের মাধ্যমে কাস্টমারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আরজে নিরব।

কিউকমের প্রতারণার বিষয়টিও সামনে আসার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর নিরব তার ফেসবুকে লেখেন, মনে হয় এই শিল্পটা বন্ধ না করে কেউ থামবে না। একজন সৎ কর্মচারী হিসেবে বিপদের দিনে মালিকের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছিলাম, যেন গ্রাহক তার টাকাটা ফেরত পায়। সঠিকভাবে গুছিয়ে কাজ করতে পারলে হয়তো তা সম্ভবও। কিন্তু মনে হচ্ছে, আপনারা যদি পণ করে বসেছেন চাকরিটা না ছাড়া পর্যন্ত আমার পিছু ছাড়বেন না! তবে তাই হোক!


কিউকমের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে গণমাধ্যমকর্মীরা যোগাযোগের চেষ্টা করায় সাংবাদিকদের তাচ্ছিল্য করে গত ২১ সেপ্টেম্বর নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেন নিরব।

টাকা নিয়েও কিউকম থেকে সময়মতো পণ্য না দেওয়ায় ৮ অক্টোবর রাতে নিরবের বিরুদ্ধে একজন গ্রাহক তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করন। পরে শুক্রবার (৮ অক্টোবর) ভোরে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুইদিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে শুনানি শেষে আদালত একদিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেন। এর আগে প্রতারণার অভিযোগে কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিপন মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের এডিসি হাফিজ আল ফারুক বলেন, কিউকমের প্রতারণার মাস্টারমাইন্ড হুমায়ূন কবির নিরব ওরফে আরজে নিরব। তার বিরুদ্ধে গতকাল রাতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় এক ভুক্তভোগী মামলা করেছেন। সেই মামলায় তাকে আজ ভোরে রাজধানীর আদাবর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর দুপুরে আরজে নিরবকে আদালতে তোলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক রুহুল আমিন তার পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম মাহমুদা আক্তার একদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

এডিসি হাফিজ আল ফারুক আরও বলেন, আরজে নিরব সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল মাধ্যমে কিউকম সম্পর্কে প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতেন। আর তার কথায় বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষ লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন। তার পরামর্শে প্রতিষ্ঠানটির সিইও মো. রিপন মিয়া প্রতারণা করে গ্রাহকদের ২৫০ কোটি টাকা আটকে রেখেছেন।


কিউকমের সিইও:

এর আগে কিউকমের সিইও রিপন মিয়াকে গত ৩ অক্টোবর গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) মতিঝিল বিভাগ। তিনি গ্রাহকের ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বৃহস্পতিবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

গ্রেফতারের পরদিন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার সংবাদ সম্মেলন বলেন, রাজধানীর পল্টন থানায় এক ভুক্তভোগী কিউকমের মালিক মো. রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রতারণার অভিযোগে একটি মামলা করেন। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ডিবি মতিঝিল বিভাগ গ্রেফতার করে। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার পণ্য আটকে রাখা হয়েছে।

একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, রিপন মিয়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে- কিউকম পণ্য অনলাইনে কেনাবেচা করে আসছিল। তাদের নিজস্ব ব্রান্ডিং করার জন্য তারা ব্যাপকভাবে মোটরসাইকেল বিক্রি করে। বিভিন্ন অফারের মাধ্যমে কিউকম লোভনীয় দামে মোটরসাইকেল বিক্রি করার বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিল। বাজারে যেই মোটরসাইকেলের দাম ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা, সেটি তারা ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করার বিজ্ঞাপন দিত। বিপুল সংখ্যক ক্রেতা অর্ডার করে মোটরসাইকেল না পেয়ে হতাশায় ভোগে। এক্ষেত্রে রিপন মিয়া আরও জানান, সে মোটরসাইকেল ডেলিভারি না দিয়ে ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার চেক দিয়ে দিত গ্রাহকদের।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা জানি যে, বাংলাদেশ ব্যাংক জুন মাস থেকে এস্ক্রো সিস্টেম চালু করে। এর অধীনে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পেমেন্ট গেটওয়ে সিস্টেম চালু করে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ফোস্টার নামে একটি কোম্পানিকে এ দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহকের পেমেন্টটি ফোস্টারের কাছে থাকবে।

একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, পণ্য ডেলিভারির পর পেমেন্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠাবে ফোস্টার। কিউকমের পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে চেক প্রদানের বিষয়টি ফোস্টারের নজরে আসে। পরে ফোস্টার কিউকমের সব পেমেন্ট আটকে দেয়। ফোস্টার এখন পর্যন্ত কিউকমের ৩৯৭ কোটি টাকা মোটরসাইকেলের পেমেন্ট আটকে দিয়েছে বলে রিপন মিয়া ডিবি পুলিশের কাছে দাবি করেন। এ ছাড়া রিপন মিয়া গ্রাহকদের পণ্য ডেলিভারির আরও ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে দাবি করেন ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার।

খ্যাতি কাজে লাগিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে অনলাইন ব্যবসা:

সাম্প্রতিক অনলাইন ব্যবসা যেমন ফুলে-ফেঁপে উঠছে, পাশাপাশি বাড়ছে প্রতারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। আর এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে ব্যবহার করছে দেশের নামিদামি তারকাদের।

খ্যাতিমান তারকা মাশরাফি বিন মর্তুজা ই-অরেঞ্জের একটি বিজ্ঞাপনে বলেছিলেন- অর্ডার করেই ফাস্ট ডেলিভারি পাবেন একমাত্র ই-অরেঞ্জ থেকে। তাই অনলাইন কেনাকাটায় আমার আস্থা ই-অরেঞ্জ। মাশরাফির এমন বিজ্ঞাপনে আস্থা রেখে ফাঁদে পড়েছেন ই-অরেঞ্জের হাজারো গ্রাহক। কেউ ছয় মাস, কেউ এক বছর আগে অর্ডার দিয়েও পণ্য হাতে পাননি।

শুধু মাশরাফি নয়, সাকিব আল হাসান, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসানের মতো নামিদামি তারকাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেছে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি। তাদের ‘তারকা খ্যাতি কাজে লাগিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে প্রতারণা করার অভিযোগ উঠেছে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে।

গ্রাহকরা বলছেন, বড় বড় তারকারা যখন এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন করেন তখন এগুলোকে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বলেই মনে করা হয়। তারা যে প্রতারণা করতে পারে এমন সন্দেহ থাকে না ক্রেতাদের। আর এটিকেই প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

আরেকটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির শুভেচ্ছাদূত হিসেবে দুই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ রয়েছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান। এ বিষয়ে তাহসান বলেন, খুব অল্প সময়ে ইভ্যালি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। তবে এর ব্যত্যয় হলে তিনি এর সঙ্গে থাকবেন না। ইভ্যালির প্রতারণা প্রকাশিত হওয়ার পর ব্র্যান্ডটির সঙ্গে আর কাজ করছেন না তাহসান। তাহসানের ফেসবুক পেজে গত ১৫ মের পর কোনো প্রচারণায় দেখা যায়নি।

টিআর/ডাকুয়া

আর্কাইভ