• ঢাকা রবিবার
    ১৩ জুলাই, ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আজ

প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২১, ০৫:০০ পিএম

ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আজ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

আজ ৩০ জুন। ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সেদিনের দেশপ্রেমিক সংগ্রাম, আদর্শ ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জুগিয়েছিল সাহস ও উদ্দীপনা। মুক্তিকামী মানুষের কাছে আজও তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক দুই ভাই— সিধু মুরমু ও কানু মুরমু স্মরণে ও শ্রদ্ধায় সাঁওতালদের অনেকেই দিনটিকে সিধু-কানু দিবস বলে থাকেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় দালাল সামন্ত জমিদার, সুদখোর, তাদের লাঠিয়াল বাহিনী, দারোগা-পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতাল নেতা সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব— এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ান সাঁওতালরা। সঙ্গে ছিলেন তাদের দুই বোন ফুলোমনি মুরমু ও ঝালোমনি মুরমু।

দামিন ই-কোহ নামে পরিচিত ভোগলপুর, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ রাজমহলের পাহাড়তলী এলাকায় ১৩৬৩ বর্গমাইল বিস্তৃত বনাঞ্চলের গাছপালা কেটে আদিবাসীরা আবাদযোগ্য জমি গড়ে তোলে এবং সেখানে ফসল ফলাতে শুরু করে। এ অবস্থা দেখে বিট্রিশ সরকার তাদের কাছ থেকে খাজনা নিতে শুরু করে। পরবর্তীতে এর মাত্রা আরও অনেক গুণ বেড়ে যায়। এরপরও সাঁওতালদের ওপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন চলে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দামিন ই-কোহতে যখন ফসলের মাঠ ভরে যায় তখন জমিদারদের চোখ পড়ে সেদিকে।

এ অঞ্চলে ফসলের ভালো অবস্থা দেখে বীরভূম ও বর্ধমান থেকে কিছু বাঙালি এ অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। এরপর সাঁওতাল আদিবাসীদের সঙ্গে তারা মহাজনী কারবার শুরু করে দেয়। কিছু দিনের মধ্যেই অনেক আদিবাসী পরিবার ঋণের জালে আটকা পড়ে। এর কিছুদিনের মধ্যেই অঞ্চলে থানা, আদালত ও আমলারা আসে। এরপর শুরু হয় জমিদার, মহাজন, পুলিশ ও আমলাদের জুলুম-নির্যাতন। ফলে সে অঞ্চলে আদিবাসীদের টিকে থাকা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

১৮৪৮ সালের দিকে মহাজনদের জ্বালায় দামিন ই-কোহ এলাকার ৩টি গ্রামের সাঁওতাল পরিবার দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অন্যায়-অত্যাচার সাঁওতালদের ধৈর্যের মধ্যে থাকলেও মহাজনদের অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সাঁওতাল আদিবাসীরা মাঠে ফসল ফলায় আর ফসলের অধিকাংশই যায় মহাজন ও জমিদারের গোলায়। তাদের এ অবস্থা দেখে ভগনাডির নারায়ণ মাঝির চার ছেলে সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৌরব বসে থাকতে পারলেন না। তাদের অন্তরে প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু করল।

সাঁওতালদের সংকটের সময় জমিদার মহাজনেরা সুযোগ বুঝে কিছু অর্থ-শস্য অধিক সুদে আদিবাসীদের ঋণ দিত। উচ্চ হারে সুদ নিয়েও তারা ওজনে ঠকাত। তাদের নিরক্ষরতার সুযোগে মহাজন জমিদারেরা জাল স্বাক্ষর করা থেকেও বিরত ছিল না। প্রতিবাদ করলে তাদের মামলায় অভিযুক্ত করে সর্বস্বান্ত করা হয়। এই অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন চার ভাই।

সাঁওতালদের অন্যায় অত্যাচার ও মহাজনদের কবল থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে তাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা চলতে থাকে। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর স্থির করলেন সাঁওতাল রাজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তাদের অবস্থার মুক্তি হবে না। আর এই মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রয়োজন। তবে এ কর্মকাণ্ডে এলাকার খেটে খাওয়া জনগণকে শামিল করতে না পারলে তাদের বিদ্রোহের আশানুরূপ ফল হবে না। তারা সরাসরি বিদ্রোহের ডাক না দিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিলেন।

এ ক্ষেত্রে তারা একদিন এলাকার লোকজনদের জমায়েত করে ঘোষণা দিলেন তাদের চার ভাইকে ঠাকুর জিও স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে নির্দেশ দিয়েছেন অন্যায়-অত্যাচারী জোতদার, মহাজন, জমিদারদের উৎখাত করে সাঁওতাল রাজ্য কায়েমের জন্য। সাঁওতাল আদিবাসীসহ মুক্তিকামী জনতার মধ্যে এই ঘোষণা সঞ্চালিত হলো। সিধু ও কানু ঘোষণা করলেন, ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে তারা অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবেন। ১৮৫৫ সালের গোড়ার দিকে তারা একটি পরোয়ানা প্রচার করলেন। সিধু, কানুর কাছে যখন সাঁওতালরা শুনল ঠাকুর জিউ তাদের শোষকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলেছেন। তখন তারা আর বসে থাকতে পারলেন না। তারা মানসিকভাবে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।

আলোচনার জন্য ভগলাদিঘি গ্রামে সাঁওতালেরা সমবেত হলে সিদ্ধান্ত মতো পরদিন একসঙ্গে সবাই শিকারে বেরোবে। পরের দিন সিধু, কানুর নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন সাঁওতাল যুবক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে শিকারে যাওয়ার পথে দারোগা মহেশ দত্ত, ২ জন সিপাই ও কয়েকজন মহাজনের সামনে পড়ে। দারোগার সঙ্গে ২টি দড়ি বোঝাই গাড়িও ছিল। মূলত তারা সাঁওতালদের ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত জানতে পেরেছে। দারোগার সঙ্গে তাদের বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে বিদ্রোহী সিধু, কানুর সশস্ত্রদল ঘটনাস্থলে দারোগা মহেশ এবং কানু মানিক রায় নামের মহাজনকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর ভোগলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি লোকজনসহ অত্যাচারী জমিদার মহাজন অনেকে সাঁওতালদের হাতে নিহত হতে থাকে। ১৮৫৫ সালের ১৭ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানানো হয়। বিদ্রোহীরা সরকারের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সেনাবাহিনী মাঠে নামায় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে শত শত বিদ্রোহীকে হত্যা করা শুরু করে সেনাবাহিনী। এক দিকে কামান-বন্দুক, অপর দিকে তীর-ধনুকের লড়াই। কয়েক দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী ভোগলাদিঘির গ্রাম ধ্বংস করে দেয়।

সিধু, কানুর বাড়িসহ গ্রামের সব বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। আশ্রয়হীনতা ও খাদ্যহীনতার কারণে অনেকে দুর্বল হয়ে পড়েন ও অনেকে ধরা পড়লেন। বিদ্রোহীদের মনোবল ধীরে ধীরে দুর্বল হতে লাগল। কানু সঙ্গীদের নিয়ে হাজারী বাক অভিমুখে পালানোর সময় জারয়ার সিং নামক ব্যক্তির তৎপরতায় ১৮৫৫ সালের ৩০ নভেম্বরে ধরা পড়েন। শেষে কানুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, লুণ্ঠন, অত্যাচার ও হত্যার অভিযোগে ১৮৫৬ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি স্পেশাল কমিশনার এলিয়টের এজলাসে তাদের বিচার হয়। বিচারে কানুকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

এই বিদ্রোহে ৩০ হাজার আদিবাসী প্রাণ হারায়। বিদ্রোহের ১৬৬ বছর পরও আদিবাসীরা অত্যাচার আর শোষণ থেকে মুক্ত হয়নি। 

প্রতি বছর এই দিনে সিধু-কানুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি, শোভাযাত্রা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ও বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ ও দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানুসহ সব আত্মদানকারীকে। উদযাপন করে থাকে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। 

সাধারণ নিরক্ষর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস না জানলেও বংশপরম্পরায় তাদের কাছে গানে গানে বেঁচে আছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কেরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে তাদের আজও গাইতে শোনা যায়, ‘সিদো-কানহু খুড়খুড়ি ভিতরে চাঁদ-ভায়রো ঘোড়া উপরে দেখ সে রে! চাঁদরে! ভায়রো রে! খোড়া ভায়য়োরে মুলিনে মুলিনে।’

সিধু-কানু পালকিতে এবং চাঁদ-ভৈরব ঘোড়ায় চড়ে বিদ্রোহীদের পাশে থেকে তাদের উৎসাহ দিতেন। নেতাদের কাছে পেয়ে বিদ্রোহীদের মনে যে আনন্দ ও আশার আলো দেখা দিত, তারই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় এই গানে।

এমআর/এম. জামান
আর্কাইভ