• ঢাকা শুক্রবার
    ১৭ মে, ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বন্দি জীবনে মুখ ভার পশুপাখিদের

প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২১, ০৯:৪০ এএম

বন্দি জীবনে মুখ ভার পশুপাখিদের

মোশাহিদ রনি

পশুপাখির আচার-আচরণ আর খুনসুটি দেখে মন ভালো হয় না, এমন মানুষ খুব কমই আছে দুনিয়ায়। কিন্তু যখন সেই পশুপাখিরই মন খারাপ হয়, তখন আনন্দের উৎস কোথায়? বিষয়টা কিন্তু অবশ্যই ভাবনায় ফেলে সবাইকে।

সরেজমিনে রাজধানীর কাঁটাবনের পোষা প্রাণীর মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে তেমন চিত্রই।

মার্কেটের একাধিক দোকান ঘুরে দেখা যায়, একদিকে যেমন পোষা বিড়ালগুলো দুরন্তপনার বিপরীতে নিশ্চুপ শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে, তেমনি ভোজনপ্রিয় কুকুরগুলোরও অনীহা দেখা গেছে খাবারের ওপর। আর সবসময় কিচিরমিচির করা বা খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকা পাখিগুলো দোলনায় দুলছে মুখ ভার করে।বন্দিদশার মধ্যে পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে পশুপাখিগুলো এই আচরণ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

এদিকে দিনে দুইবার খাবার দেয়া হলেও বদ্ধ পরিবেশে দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি মারা যাচ্ছে কিছু প্রাণী। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাবারের পাশাপাশি যতটা সম্ভব দোকান খোলা রেখে পর্যাপ্ত বাতাস সরবরাহই পারে প্রাণীদের সুস্থ রাখতে। 

অপরদিকে চলতি লকডাউনে প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে পশু-পাখির দোকান খুলতে পারছেন না দোকান মালিকেরা। এ কারণে খাদ্য, পানি ও বাতাসের অভাবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রতিদিনই পশুপাখি ও মাছ মারা যাচ্ছে।

লকডাউনের মধ্যে বিভিন্ন দোকান বন্ধ থাকলেও পশুপাখিদের স্বার্থে প্রতিদিনই খোলা হয় এই দোকানগুলো। তবে, একদিকে যেমন ব্যবসা মন্দা, তেমনি মহামারি কোভিড চলাকালীন বন্দি থাকায় একটা বিরূপ প্রভাবও পড়েছে এই প্রাণীগুলোর ওপর।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলো-বাতাস না পেলে, নিয়মিত খাবার না দিলে, খাঁচা পরিষ্কার না করলে—একটা পর্যায়ে এগুলো মারা যায়। তাই দোকান খোলা হয় নিয়মিতই। কিন্তু যেসব বিড়াল আর কুকুর সবসময় দোকানে আগত দর্শনার্থী আর ক্রেতাদের সঙ্গে খেলা করে সময় কাটায়, তারা এখন অলস সময় পার করছে।

এ বিষয়ে ‘মিনি হবি জু’ দোকানের মালিক মো. জামাল হোসেন বলেন, মন ভালো রাখার জন্য পশুপাখির মতো নির্মল আনন্দের কিছুই নেই। এমনকি গবেষণাতেও বলা হয়েছে, পশুপাখি দেখা কেবল সময় কাটানোর ভালো উপায়ই নয় এটি মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে। সেদিক থেকে আমাদের এই পোষা প্রাণীগুলোও মানুষের সঙ্গ পেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে লকডানের ফলে এখন মানুষ না আসায় তারা যেমন শুয়ে-বসে দিন পার করছে, তেমনি আচরণেও হয়েছে পরিবর্তন। কেমন যেন মন মরা আর অলসে ভাব!

তিনি বলেন, বিড়াল, কুকুর, খরগোশ, পাখি এবং অন্যান্য পোষা প্রাণীদের পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর ভাইরাল হয়। সেলিব্রেটিরাও তাদের পোষা প্রাণী সম্পর্কে আপডেট শেয়ার করেন। সেগুলো আমাদের মুখে হাসি ফোটাবে নিশ্চিত। কিন্তু এই অলস সময়ে মানুষ ও খেলার সঙ্গী না পেয়ে তাদের মুখেই যেন হাসি নেই।

মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, যেসব তোতা পাখি, কাকাতুয়া নিজেদের খেলায়, খুনসুটিতে মন ভরিয়ে রাখে দর্শক-ক্রেতাদের; তারাও এখন বসে আছে মুখ ভার করে। খুব কাছে গেলেও যেন তাদের এখন সাড়া পাওয়া দায়। এরপর আবার উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখেন কাছে আসা মানুষটিকে। সবসময়ের চেনা ভঙি ফেলে রেখে দেখান আলাদা রূপ। যেন কোথাও কোনো তাড়া নেই, কোনো চঞ্চলতা নেই। অপরদিকে কিছু পশুপাখি আবার এই ছুটির দিনে জিরিয়ে নিচ্ছে বেশ আয়েশ করে। অন্য সময় মানুষের সমাগম বেশি থাকায় যে বিশ্রামটুকু তাদের হয় না, এখন নিরিবিলি সময়ে খাওয়া আর ঘুমের মধ্য দিয়েই শোধ নিচ্ছে তার।

এ বিষয়ে মার্কেটের বার্ডস প্যালেস, নিউ বার্ডস প্যারাডাইজ, পেটস ওয়ার্ল্ডের ব্যবসায়ীরা বলছেন, লকডাউনের ফলে আমাদের ওপর যেমন প্রভাব পড়েছে, তেমনি পশুপাখিগুলোর প্রায় একই অবস্থা। প্রাণীগুলো সবসময় মানুষ দেখে, মানুষের সঙ্গে খেলে অভ্যস্ত। হুট করে সেটা বন্ধ হয়ে গেলে একটা প্রভাব পড়ে। আবার অনেক সময় এটি ভালো দিক হিসেবেও উঠে আসে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিতে পড়লে তার প্রভাব পড়ে পশু-পাখির খাবারের ওপরও। সবমিলিয়ে ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে।

অপরদিকে চলতি লকডাউনে প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে স্টাফ, কর্মচারী না থাকায় ব্যবসায়ীরা পশুপাখির পরিচর্যার জন্য দোকান খুললেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে দোকান-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আটক-আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। 

জানা গেছে, লকডাউনের মাঝে পোষা প্রাণী ও অ্যাকুরিয়ামের মাছের জরুরি খাদ্য, ওষুধ, আলো-বাতাস সরবরাহ এবং পরিচর্যার জন্য দৈনিক দুই ঘণ্টা করে দুই দফায় কাঁটাবনের পশুপাখি মার্কেটের দোকানগুলো খোলা রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন  মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করীম। ১২ এপ্রিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর কাঁটাবনস্থ অ্যাকুয়া অ্যান্ড পেট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে লকডাউনের মাঝে অবলা পশু ও মাছের জরুরি খাবার সরবরাহ ও পরিচর্যার উদ্দেশ্যে দোকান খোলার জন্য একটি মানবিক আবেদন জানানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী সেখানকার পশুপাখির ৬০টি দোকান প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘণ্টা করে দুই দফা খোলা রাখার অনুমতি দেন। 

কাঁটাবনস্থ অ্যাকুয়া অ্যান্ড পেট অ্যাসোসিয়েশন ও কাঁটাবন দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'পশুপাখি-মাছ কি আটকে রাখা যায়। এক ঘণ্টা পর পর তাদের পরিচর্যা করতে হয়। দোকানের শাটার বন্ধ করলেই তাদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ পর্যন্ত বেশ কিছু পশুপাখি-মাছ মারা গেছে। লকডাউনে স্টাফ, কর্মচারী না থাকায় এগুলোর পরিচর্যার জন্য ব্যবসায়ীরা দোকান খুললেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৬-১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। অবশ্য তাদের দীর্ঘক্ষণ আটক রেখে পরে ছেড়ে দেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে পশুপাখি ও মাছের জীবন বাঁচাতে দোকান খোলা রাখতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।' 

ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. সাজ্জাদুর রহমান জানান, জীবন্ত পশুপাখি বা মাছের দোকান প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলার নির্দেশনা দেয়া আছে। এর মধ্যে কেউ দোকান খুলতে বাধা দিলে বা কাউকে হয়রানি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর বাইরেও যদি কাঁটাবন দোকান মালিকদের আরও কোনো সুবিধার প্রয়োজন হয় তবে আলোচনা করতে পারেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করব।

তবে, ক্রেতা-দর্শনার্থীদের দেখিয়ে দেখিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে খুনসুটি করা পশুপাখিগুলো আবারও ফিরবে মানুষের ভিড়ের সঙ্গে, মজবে খুনসুটিতে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এমন অপেক্ষা যেন একই পশুপাখিগুলোরও।

এমআর/এএমকে
আর্কাইভ