• ঢাকা শুক্রবার
    ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জায়েদাকে গুরুত্ব না দেওয়ার আ.লীগের হার

প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২৩, ০৫:১৬ পিএম

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জায়েদাকে গুরুত্ব না দেওয়ার আ.লীগের হার

ছবি: সংগৃহীত

গাজীপুর প্রতিনিধি

মনোনয়নপত্র দাখিলের আগপর্যন্ত জায়েদা খাতুনের নামও জানতেন না অনেকে। ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা হিসেবেই ছিল তাঁর পরিচয়। সেই জায়েদা এখন গৃহান্তরাল থেকে নগরমাতা। রাজনীতি ও নির্বাচনে নবীন জায়েদা খাতুনের কাছেই ধরাশায়ী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঝানু মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান। তা-ও প্রায় ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে। চমক জাগানো এই ফলাফল নিয়েই গাজীপুরসহ দেশজুড়ে চলছে নানান বিশ্লেষণ। চলছে কারণ খোঁজার চেষ্টা।

রাজনীতিবিদসহ গাজীপুরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বলছেন, জায়েদা খাতুনকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে তাঁর ছেলেকে প্রতিপক্ষ করা, প্রচারে আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়হীনতা, দলের একটি অংশের ছদ্মবেশে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের পক্ষে কাজ করা, অন্যান্য দলের সমর্থকদের ভোট, মা-ছেলের দল বা নৌকা প্রতীক নয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভোট প্রার্থনা এবং বিপুল নারী ভোট এই ফলাফলের কারণ। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারলেও দল হারেনি। কারণ, জায়েদা খাতুনও আওয়ামী লীগ পরিবারের। অন্যদিকে এটিকে ব্যক্তি আজমতের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরের জয় বলছেন অনেকে।

অনেকে বলছেন, ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হলো ২০২৩ সালে গাজীপুরে। সেবার নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডাকসাইটে নেতা শামীম ওসমানকে প্রায় দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেশের প্রথম নারী মেয়র হয়েছিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। আওয়ামী লীগের একাংশের আশীর্বাদ পাওয়া আইভী নৌকা প্রতীকের চেয়ে ব্যক্তিকে হারানোর ওপর জোর দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর মাকে নিয়ে প্রচারে নৌকা নয়, ব্যক্তিকে হারানোতে জোর দিয়েছেন। দলের একজন বড় নেতার সমর্থন পাওয়ার কথাও বলাবলি হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা মন্তব্য করেননি।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের রাতে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি। পরদিন গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে এটি প্রভাব ফেলেছে–এমনটি কেউই মনে করছেন না। তাঁরা বলছেন, আওয়ামী লীগ জাহাঙ্গীরকে দুই দফায় বহিষ্কার করলেও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একটি অংশ তাঁর পক্ষেই ছিল। নির্বাচনে তাঁরা মা-ছেলের পক্ষেই কাজ করেছেন। অনেক কেন্দ্রেও দেখা গেছে, নৌকার ব্যাজ ঝোলানো কর্মীরা টেবিল ঘড়িতে ভোট চেয়েছেন। এ ছাড়া মেয়র পদ থেকে ২০২১ সালে সাময়িক বরখাস্ত হলেও বেশির ভাগ কাউন্সিলর তাঁর পক্ষে ছিলেন। তাঁরা জাহাঙ্গীরের পুনর্বহাল চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন। এই কাউন্সিলররা এবারও জয়ী হয়েছেন এবং তাঁরাও জায়েদা খাতুনের পেছনে থাকা জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করেছেন। তাঁরা মনে করছেন, জায়েদা খাতুন মেয়র হলেও নেপথ্যে করপোরেশন চালাবেন তাঁর ছেলে।

স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেছেন, তাঁরা মনে করেছিলেন জাহাঙ্গীর ও জায়েদা খাতুন এক নয়। তাই জায়েদা খাতুনকে বড় প্রতিপক্ষ না ধরে দলের নেতারা জাহাঙ্গীরকে প্রতিদ্বন্দ্বী গণ্য করেন, যা ছিল বড় ভুল। তাঁদের আরেকটি ধারণা ছিল, টঙ্গীর বিএনপি ঘরানার প্রভাবশালী সরকার পরিবারের সন্তান স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম (রনি) আওয়ামী লীগবিরোধী বিপুল ভোট পাবেন। কিন্তু বাস্তবে সেই ভোটও জায়েদা খাতুন পেয়েছেন। এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামেরও সখ্য আছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে তিনটি সংসদীয় আসন রয়েছে। এই তিন সংসদ সদস্যের মধ্যে আ ক ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, জাহিদ আহসান রাসেল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং মেহের আফরোজ চুমকি সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী।

চুমকি মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি। টঙ্গীতে জাহিদ আহসান রাসেলের বাড়ি হায়দারবাদের একটি কেন্দ্রে টেবিল ঘড়ি পেয়েছে ১ হাজার ২৮৪ ভোট আর নৌকা পেয়েছে ৫৮৭ ভোট। আজমত উল্লা নিজ এলাকা টঙ্গীতে বিপুল ভোটে এগিয়ে থাকবেন, এই ধারণাও বাস্তবে মেলেনি। এ ছাড়া নারীদের ভোট বেশির ভাগই পেয়েছেন জায়েদা খাতুন। অনেক নারী টেবিল ঘড়িতে ভোট দেওয়ার কথা কেন্দ্রে প্রকাশ্যেই বলেছেন।

আজমত উল্লার নির্বাচন পরিচালনায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ১৭ সদস্যের একটি কমিটি করেছিল। এর প্রধান ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তবে তাঁকে ও দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ছাড়া কমিটির বেশির ভাগ নেতাকেই প্রচারে দেখা যায়নি। অথচ ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরের পক্ষে প্রচারে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী।

গতকাল যোগাযোগের চেষ্টা করে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কমিটির এক নেতা সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাঠের যে পরিস্থিতি দেখেছি, তাতে হারার কথা ছিল না। নেতারা অসহযোগিতা করেছেন, এটা নিশ্চিত। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অনেকেই গোপনে জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করেছেন। শীর্ষ নেতারা এ বিষয়ে হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলবেন।’

কমিটির আরেক সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম গতকাল বলেন, তিনি সংসদ সদস্য। আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে বলে তিনি প্রচারে অংশ নিতে পারেননি।

এদিকে নির্বাচন পরিচালনায় গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ ৯ সদস্যের উপদেষ্টামণ্ডলী ও ১০২ সদস্যের কমিটি গঠন করে। তবে সংসদ সদস্য হওয়ায় এই উপদেষ্টামণ্ডলীর অনেকে প্রচারে নামেননি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনী এলাকার বাইরে একাধিক মতবিনিময় ও বর্ধিত সভা করায় নির্বাচন কমিশন তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। সূত্র বলেছে, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লা মন্ডলকে প্রধান করে গঠিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মধ্যে ছিল সমন্বয়ের ঘাটতি। কমিটিতে জ্যেষ্ঠরা জায়গা পাননি। আবার জায়গা পাওয়া কয়েকজন জাহাঙ্গীরঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। কমিটির অন্তত ১২ সদস্য কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছেন। তাঁদের নিজেদের প্রচার নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। কমিটিতে জায়গা না পাওয়া ওয়ার্ডে তাঁদের দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আজমতের বিপক্ষে ছিলেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আজমত উল্লা ভেবেছিলেন নৌকা প্রতীকের কারণে তিনি সহজেই জিতে যাবেন। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি এবং জেলা ও মহানগর নেতাদের বেশির ভাগের পরামর্শে তিনি গুরুত্ব দেননি। শিল্প এলাকা হওয়ায় ভাসমান ভোটাররাও ভূমিকা রেখেছেন ফলাফলে।

গাজীপুরের অনেকে বলছেন, জাহাঙ্গীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও সহায়তার মাধ্যমে শক্ত একটি অনুসারী বলয় তৈরি করেছেন। উদার হাতে তাঁর খরচের কথা মানুষের মুখে মুখে। দল-মত নির্বিশেষে অনেক মানুষ তাঁর সহায়তা পেয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের একটি বড় অংশও জাহাঙ্গীরের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁরা অনেকটা প্রকাশ্যেই নির্বাচনে তাঁর পক্ষে কাজ করেছেন। অন্যদিকে দলের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আজমত খেয়াল রাখেন না।

তিনবারই টঙ্গীর হার
গাজীপুর সিটির এ পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনেই (২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালে) হেরেছেন টঙ্গীর বাসিন্দা মেয়র প্রার্থী। প্রথম নির্বাচনে জয়ী বিএনপির এম এ মান্নানের বাড়ি ছিল সালনার কাউলতিয়া, হেরেছিলেন টঙ্গীর আজমত। ২০১৮ সালে গাজীপুরের ছয়দানার জাহাঙ্গীরের কাছে পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থী সাবেক এমপি টঙ্গীর হাসান উদ্দিন সরকার। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে সেই জাহাঙ্গীরের মায়ের কাছে হারলেন টঙ্গীর বাসিন্দা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত।

প্রায় পৌনে ১২ লাখ ভোটারের মধ্যে সাড়ে চার লাখের অবস্থান টঙ্গীতে। নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫০টি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুরের সভাপতি অধ্যাপক আমজাদ হোসেনের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোটারদের আবেগে জিতেছেন জায়েদা খাতুন ও জাহাঙ্গীর। ভোটের আগে জায়েদা খাতুনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় সমবেদনা ছিল সাধারণ মানুষের। জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিলেও অনেকে আবেগী হয়েছেন। এ ছাড়া নারী ভোটারদের একটি বড় প্রভাব ছিল ফলাফলে।

 

জেকেএস/
 

আর্কাইভ