প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২২, ০১:৪৪ এএম
ওয়াহিদুল ইসলাম ডিফেন্স, ফুলবাড়ী প্রতিনিধি
ঋতু
বৈচিত্র্যে এই বাঙলায় বর্তমানে মধু মাস। আর মধু মাস মানেই বিভিন্ন ফলের পসরা;
কিন্তু বাঙালির আম-লিচুর তুলনাই হয় না।
আম-লিচু বহনকে কেন্দ্র করেই এই মৌসুমে বাঁশের ঝুড়ি বা
টুকরির কদর বাড়ে। তাই এই সময় বাঁশের তৈরি ঝুড়ি
তৈরি করতে অনেক ব্যস্ত সময় পার করেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর
ইউনিয়নের জয় নগর গ্রামের মাহালি সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্তু শুধু মৌসুমে আম-লিচুর জন্য বাঁশের ঝুড়ি তৈরি হলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্লাস্টিকের তৈরি
ক্যারেটের প্রতিযোগিতায় বাঁশের তৈরি এই শিল্প আজ হুমকির মুখে। ফলে এই পেশার সঙ্গে
জড়িতদের মৌসুমছাড়া মাহালি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পেশাকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘদিন
থেকেই এই পেশায় জড়িত মাহালি সম্প্রদায়ের লোকজন। বাঁশের চটা দিয়ে চাটাই,
কুলা, ডালা, চাঙারি,
টুকরি, ওড়া, চালুনি,
মাছ রাখার খলইসহ নানা জিনিস তৈরি করেন তারা।
সরেজমিনে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূর ফুলবাড়ী-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের ধারে জয়নগর মাহালি পাড়া। এই গ্রামে ৩৬টি পরিবারের বসবাস। কমবেশি সবাই বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশা ধরে রেখেছে। মাহিলা পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় স্টেফান সরেন ও তার স্ত্রী মিনা মার্ডি, সুধীর মার্ডি ও তার স্ত্রী সোনা মনি হেমব্রম এবং সুজন মার্ডি, হেমচন্দ্র মার্ডি ও রমেশ মার্ডি আম-লিচুর মৌসুমে আম-লিচু পরিবহনের জন্য টুকরি তৈরি করছেন তবে ব্যস্ততা একটু কম।
ব্যস্ততা
কম এমন প্রশ্নের জবাবে স্টেফান সরেন ও সোনা মনি হেমব্রম বলেন,
‘এবার আমের জন্য ঝুড়ি বা টুকরি তৈরি করছেন না। তবে
লিচুর জন্য করছে।’ কারণ হিসেবে স্টেফান
সরেন বিষন্ন মনে বলেন, ‘প্লাস্টিকের ক্যারেট বাজারে আসার
পর থেকে কেউ টুকরি তৈরি করে নিতে চায় না।’
তিনি
আরও বলেন,
‘লিচুর জন্য কিছু পাইকাড় এবং মানুষজন আসেন তাই বর্তমানে লিচুর
ঝুড়িই বানাচ্ছেন। তা ছাড়া প্লাস্টিকের ক্যারেট আসার পর আম পরিবহনের জন্য ঝুড়ি নিতে
চায় না কেউ। শুধুই লিচুর জন্য ঝুড়ি নিতে আসেন। তা ছাড়া বাঁশের দাম বেশি। বাঁশ
কিনে এনে ঝুড়ির জন্য প্রস্তুত করে দিনে স্বামী-স্ত্রী মিলে ৪/৫টি ঝুড়ি তৈরি করা যায়।
সুধীর
মার্ডি নামে একজন বলেন, ‘এক সময় প্রতিযোগিতা করে
ঝুড়ি তৈরি করতাম। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। কারণ আমের জন্য প্লাস্টিকের ক্যারেট
ব্যবহার করায় শুধুই লিচুর ঝুড়ি তৈরি করছি।’ তারা স্বামী-স্ত্রী দিনে ৮/১০টি ঝুড়ি তৈরি করেন। বিক্রি হয় ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা
পর্যন্ত। ঝুড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের তেমন লাভ থাকে
না। বাঁশের দাম বাড়ার কারণে ঝুড়ি তৈরির খরচ বাড়লেও বাড়েনি ঝুড়ির দাম।’
তিনি
আরও বলেন,
‘এখন একটি বাঁশ আমাদের কিনতে হয় ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। একটি
বাঁশ থেকে সর্বোচ্চ ৬-৭টি ঝুড়ি তৈরি হয়। প্রতিটি লিচুর ঝুড়ি
বিক্রি হয় ৮০-৯০ টাকায়। সে হিসেবে ৬-৭টি ঝুড়ি বিক্রি করে খুব বেশি লাভ হয় না। তার ওপর ৬-৭টি ঝুড়ি তৈরিতে পরিশ্রম কম না। তারপরেও পূর্বের মতো ব্যবসা নেই,
এখন সব প্লাস্টিকের পাওয়া যায়। তা ছাড়া বাঁশ দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রে
খাটুনি বেশি মূল্য কম। তবুও আমার পূর্ব পুরুষদের এই পেশা ধরে রেখেছি ‘
ফুলবাড়ী
পৌর বাজারের ফল ব্যবসায়ী গোপাল মহন্ত বলেন, ‘বাঁশের
তৈরি ঝুড়ির চাইতে প্লাস্টিকের ক্যারেটে আম ও পণ্য পরিবহনে অনেক সুবিধা রয়েছে।
প্লাস্টিক ক্যারেটে আম পরিবহনে আম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। যা বাঁশের তৈরি ঝুড়িতে
অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়ও প্লাস্টিকের ক্যারেট কয়েকবার ব্যবহার করা যায়। কিন্তু
বাঁশের তৈরি ঝুড়ি একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না।’
এই
শিল্প টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতার পশাপাশি আধুনিকতা ছোঁয়ায় পরিবেশবান্ধব বাঁশের
ঝুড়ি যেন হারিয়ে না যায় এবং প্লাস্টিকের
ক্যারেটের পরিবর্তে বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহারে উদ্ভুদ্ধকরণে এগিয়ে আসার দাবি করেন সুশীল
সমাজের লোকেরা।
দৌলপুর
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মাহালি
সম্প্রদায়ের মানুষজন পারিবারিক ঐতিহ্য ও পেশা হিসেবে বাঁশ ও বেতের কাজ করে জীবিকা
নির্বাহ করেন। এসব পণ্য পরিবেশের জন্য উপকারী। পরিবেশবান্ধব এই শিল্পকে ধরে রাখতে
সাধ্যমতো সহায়তা দেওয়া হবে।
এএমকে