• ঢাকা শুক্রবার
    ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা সৈনিক সাংবাদিক রণেশ মৈত্রের পরলোক গমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২, ০৫:৪৪ পিএম

ভাষা সৈনিক সাংবাদিক রণেশ মৈত্রের পরলোক গমন

পাবনা প্রতিনিধি

ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশবরেণ্য একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, পাবনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক রণেশ মৈত্র পরলোক গমন করেছেন।

সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ভোর ৩টা ৪৭ মিনিটে ঢাকা পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।

সম্প্রতি তিনি মফস্বল সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখায় বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।

দেশবরেণ্য প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট রণেশ মৈত্রের পরলোক গমনের খবর পাবনায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া।

পাবনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদ তার পরলোক গমন নিশ্চিত করে বলেন, তার সন্তান অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। তিনি পৌঁছানোর পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে।

তথ্যমতে, ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর রাজশাহী জেলার ন’হাটা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক বাসস্থান পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। বাবা রমেশ চন্দ্র ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই রণেশ মৈত্র টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।

নিজ জীবন সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়েই রণেশ মৈত্র দেশের অসহায়, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেন। ১৯৫০ সালে পাবনা জিসিআই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৫ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫১ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে তিন বছর সাংবাদিকতার পর ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং নিউজ এবং ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দৈনিক অবজারভারে পাবনা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে দি নিউ নেশনের মফস্বল সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দি ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে দেশের শীর্ষ পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে সারাদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন।

এ ছাড়া ১৯৬১ সালে পাবনায় পূর্ব পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত পূর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকরা তাদের পেশার স্বীকৃতি পায়। সেই বছরেই প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

এ ছাড়া তিনি দীর্ঘদিন প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে জেলার সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন ।

১৯৪৮ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রণেশ মৈত্রের রাজনৈতিক জীবন। একই সময়ে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেল খেটেছেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকা জেলে বন্দি, রাজশাহী জেল থেকে পরীক্ষা উপলক্ষে রণেশ মৈত্রকে ঢাকা জেলখানায় নেওয়া হয়। জেলখানার ভেতর প্রতিদিন সকাল-বিকালে হাঁটতেন বঙ্গবন্ধু। তার হাঁটার সময় বন্দিরা দূরে দূরে থাকতেন, অথবা তাদের দূরে দূরে রাখা হতো।

একদিন রণেশ মৈত্র সাহস করে এগিয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু ভালোবেসে তাকে হাঁটার সঙ্গী করে নেন। এরপর থেকে প্রতিদিন তার সঙ্গে হাঁটতেন। হাঁটতে হাঁটতে তাদের মধ্যে অনেক আলাপ হতো। তরুণ বামপন্থী ছাত্রনেতা রণেশ মৈত্র বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি নিয়ে অনেক অভিযোগ করতেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা শুনতেন আর হাসতেন। একদিন তিনি বললেন, আমার লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শুনে বামপন্থী ছাত্রনেতা রণেশ মৈত্র মুখের ওপর বলেই ফেললেন, আপনাকে দিয়ে আর যাই হোক স্বাধীনতা হবে না। কারণ আপনার কেবলা তো আমেরিকা। আমেরিকা অন্তত আপনাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে দেবে না। বঙ্গবন্ধু বলেন, শোন রণেশ, আমার বিভিন্ন উইং বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। তাজউদ্দিনসহ যারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে তাদের কাজ ভিন্ন। অন্যরা কাজ করছে ভিন্ন উইংয়ে।

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতিক রণেশ মৈত্র মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন জনস্বার্থের আন্দোলনে সব সময় সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি পাবনা জেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন। সেই বছরেই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।

রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশ অবজারভারের আব্দুল মতিন, কামাল লোহানীসহ প্রগতিশীল বন্ধুদের সঙ্গে গঠন করেন শিখা সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সেখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল, যেখান থেকে শিখা নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশিত হতো।

ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ পাক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তিনি বহুবার কারাবরণ করেন। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৬৭-এর দিকে তিনি মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ঐক্য ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও পাবনা জেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

সফল আইনজীবী হিসেবেও দীর্ঘদিন তিনি দায়িত্ব পালন করে পরে সেখান থেকেও স্বেচ্ছায় অবসর নেন।

তার স্ত্রী পূরবী মৈত্র বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি। ৪ ছেলেমেয়ে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রুদ্র চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ’ পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। এ ছাড়া তার প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গ পথিক’ তার জীবনের উপর বিভিন্নজনের এক বর্ণিল চিত্রগাঁথা। উল্লেখযোগ্য তার লেখা বাংলাদেশ কোন পথে? আত্মজীবনী, আলোচিত গ্রন্থ ‘রুদ্র চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ’। আঁধার ঘোচানো বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু রচিত জেলখানার ডায়েরি বাঙলা একাডেমি প্রকাশিত ‘কারাগারের রোঁজনামচায় তিনি রণেশ মৈত্রের নাম ছয়বার উল্লেখ করেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা, খ্যাতিমান সাংবাদিক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রিয় শিক্ষক, উদ্যমী সমাজসেবী কতই না পরিচয় রণেশ মৈত্রের। এখন বয়স নব্বই বছর ছুঁতে চলেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু তিনি দেশের টানে, প্রিয় বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার সংকল্প থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সশস্ত্র সংগ্রামে। তরুণ বয়সেই ভাষা আন্দোলনে নিজেকে সপে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছেন। আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির হাল ধরেছেন। করোনাকালে একাত্তরের মতো ছোটাছুটির সুযোগ নেই। কিন্তু বয়স যা-ই হোক, অমিত তেজী তো বটেই। মনের জোর রয়েছে সেই ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক থাকার সময়ের মতো। ভয়ঙ্কর ভাইরাস কোভিড-১৯ কী করে থামাবে তাকে? করোনাকালে তিনি লিখে ফেললেন তিনশ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী।

গুণী এই ব্যক্তির পরলোক গমনে তাৎক্ষণিকভাবে পাবনার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ নানা পেশাজীবী সংগঠন ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শোক ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন।

এএল/

 

আর্কাইভ