
প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২৫, ১০:০৮ এএম
অমাবস্যা তিথির দ্বিতীয় জোর শেষ দিন বৃহস্পতিবার। মধ্যরাতে মেঘের গর্জন, বজ্রপাত, অতি ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের স্রোতে বিশ্বের অন্যতম জোয়ার-ভাটার মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে রুই জাতীয় মা-মাছ ডিম ছেড়েছে। আর এ নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কেজি।
প্রায় দুই মাস ধরে ডিম সংগ্রহকারীদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত রুই জাতীয় (রুই, কাতল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়ে। এতে অর্ধশতাধিক ডিম সংগ্রহকারী আশায় বুক বাঁধে এবং মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহে নদীতে নেমে পড়ে। যদিও এর আগে অন্তত দুই দফা নমুনা ডিম ছেড়েছিল মা মাছ।
ওই দিন রাত আনুমানিক ২টার দিকে প্রকৃতির এই অনুকূল পরিবেশে পুরানো ঐতিহ্যকে ধারণ করে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার হালদা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মা-মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। মা-মাছ ডিম ছাড়ার আগ মুহূর্ত থেকে নদীতে অবস্থানরত ডিম সংগ্রহকারীরা মা-মাছের ডিম ছাড়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে হাঁকডাক শুরু করে।
এ সময় নদীতে অপেক্ষারত প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ডিম সংগ্রহকারী ৩৫০-৪০০ শত নৌকা, জাল ও পাতিলসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের জৌলুসে মেতে ওঠে। তবে, ভোর রাতের দিকে একটু বৈরি আবহাওয়ায় স্বাভাবিক ডিম সংগ্রহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে।
এরপরও সবচেয়ে আনন্দের খবর, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ভালো পরিমাণ ডিম সংগৃহীত হয়েছে বলে ধারণা করছেন হালদা গবেষকরা। ফলে ডিম সংগ্রহকারীদের চোখে-মুখে প্রাপ্তির প্রাপ্তির ঢেঁকুর তুলতে দেখা গেছে।
এদিকে সব তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করে শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে নিশ্চিত করা হয়, এবার হালদা নদীতে মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কেজি। মৎস্য অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্স ল্যাবরেটরি এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট যৌথভাবে এ তথ্যটি প্রণয়ন করে বলে জান
সরেজমিন ঘুরে এবং ডিম সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাত আনুমানিক ২টা থেকে হালদা নদীর মদুনাঘাট ছায়ারচর হতে রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতার ঘোনা, আজিমের ঘাট, মাছুয়াঘোনা, কাগতিয়া, সিপাহী ঘাট, নয়াহাট, পুরালিয়া স্লুইসগেট, কেরামতালির বাক এবং অঙ্কুরীঘোনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহ করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পেরে অনেক ডিম সংগ্রহকারীরা খুবই খুশি। এই ডিম সংগ্রহ কার্যক্রম শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত চলে।
এ সময় প্রতি নৌকায় ৩-১২ বালতি (৮-১০ লিটার পরিমাপের বালতি) পর্যন্ত মা-মাছের নিষিদ্ধ ডিম সংগ্রহ করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতি নৌকায় সর্বনিম্ন ৩-৪, সর্বোচ্চ ১০-১২ এবং গড়ে ৭-৮ বালতি ডিম সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি বলে জানান ডিম সংগ্রহকারীরা।
হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে হালদা নদীতে মা-মাছ ডিম ছাড়েনি। তবে, তিন-চার বারের নমুনা ডিমের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি। ২০২৩ সালে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি। তাছাড়া ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি, ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। এর আগে ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
ডিম সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন, চৈত্র মাসের শেষার্ধ থেকে হালদা পাড়ের জেলেরা জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে অপেক্ষার পর ডিম সংগ্রহের উৎসবে মেতে ওঠেন আহরণকারীরা। বৃহস্পতিবার অমাবস্যার শেষে আকাশে বজ্রপাত আর সঙ্গে শুরু হয় মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ। এর মধ্যেই হালদায় নামে পাহাড়ি ঢল নামলে নদীতে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে মা মাছ ডিম ছাড়ে। এরপর নৌকা, জাল ও পাতিলসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে ডিম সংগ্রহকারীরা। তবে কিছু এলাকায় ডিম সংগ্রহকারীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিম পেয়েছেন। প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়ার কারণে কিছু এলাকায় ডিম সংগ্রহকারীরা প্রত্যাশিত পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করতে পারেননি।
এবার ডিমের পরিমাণ কেমন, জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা নয়হাট এলাকার প্রবীণ ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, সারা বছর আমরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করি। ভালো ডিম সংগ্রহ হয়েছে এবার। বিশেষ করে কাগতিয়া, সিপাহী ঘাট, নয়াহাট, পুরালিয়া স্লুইসগেট ও কেরামতালির বাকসহ আরও ২-৩টি এলাকায় ডিম সংগ্রহকারীরা প্রত্যাশিত পরিমাণে মা মাছের ডিম সংগ্রহ করেছে। এছাড়া তিনি এবার ১০টি নৌকায় প্রায় ৩৫-৩৭ বালতির মতো মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন। এবার প্রচুর ডিম সংগ্রহ করতে পারায় তারা সকলে বেশ খুশি বলে তিনি জানান।
তিনি আরও জানান, অভিজ্ঞ ডিম সংগ্রহকারীরা মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে সরকারি হ্যাচারি, মাটি ও সিমেন্টের কুয়ায় এসব ডিম থেকে রেনু ফোটাবেন। চার দিন পর রেনু ফুটবে। নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে এখন। তারপর নির্দিষ্ট সময় শেষে পোনা বিক্রি হবে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এসব রেনুর পোনা দ্রুত বড় হয় বলে সারা দেশের মাছচাষিদের প্রথম পছন্দ। তাই দামও অনেকাংশে বেশি।
এ ব্যাপারে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন আজাদী জানান, নদীর পারে স্থাপিত সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারি এবং ট্রেডিশনাল মাটির কুয়াগুলোতে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিমের পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। নদীতে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ-পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথ ভাবে ডিম সংগ্রহের তথ্যসংগ্রহ এবং নদীর সার্বিক পরিবেশ মনিটরিং করছে। রাতভর ডিম সংগ্রহ করে সকালে ডিম সংগ্রহকারীরা সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমগুলো হ্যাচারিতে নিয়ে। সেখানে কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক উপায় ১৮ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেনু হবে। তারা তিনদিন ধরে রেনুগুলোকে নার্সিং করা হবে। এরপর পোনায় পরিণত হবে সেগুলো। অর্থাৎ সংগ্রহের ৯৬ ঘণ্টা পর মা মাছের ডিম বিক্রয়যোগ্য পোনায় পরিণত হবে।
অন্যদিকে ডিম ছাড়ার পর ক্লান্ত মা মাছগুলো যাতে কেউ শিকার করতে না পারে এবং কৃত্রিম রেনু বিক্রেতারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম মশিউজ্জামান।
তিনি বলেন, হালদাকে আগের রূপে ফেরাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানান পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গত এক বছরে হালদার মা মাছ রক্ষা করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ড্রেজার, ঘেরা ও ভাসা জাল, বড়শি, বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহার করা নৌকা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হালদা পুরনো রূপ ফিরে পাচ্ছে। প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ডিম সংগ্রহকারীরা পর্যন্ত পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছে। এতে ডিম সংগ্রহকারীর পাশাপাশি স্থানীয়রা খুশি এবং আমরাও খুশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রির্সাচ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক হালদা গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, বহুল প্রত্যাশিত হালদা নদীতে রুই জাতীয় মা মাছ ডিম ছেড়েছে। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ২টা থেকে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম সংগ্রহ শুরু করে। প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ডিম সংগ্রহকারীরা প্রতি নৌকায় ৩-১২ বালতি (৮-১০ লিটার পরিমাপের বালতি) পর্যন্ত মা-মাছের নিষিদ্ধ ডিম সংগ্রহ করেছে। আমরা হালদা নদীতে মা মাছের ডিম সংগ্রহ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছি। এবার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পরিমাণে ডিম সংগ্রহ হয়েছে। আমি মনে করি, আজকের ডিম প্রাপ্তি হালদা নদী রক্ষায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনার একটি ফসল। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, এনজিও আইডিএফ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সমন্বিতভাবে নিরলস কাজ করছে হালদা নদী রক্ষায়। হালদা নদী বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার একটি সফল উদাহরণ।