
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০৯:২৯ পিএম
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে এখনো ক্যাম্পাসজুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষের নেপথ্য কারণ জানতে চেষ্টা করেছে সিটি নিউজ ঢাকা। এতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ গ্রামীবাসীকে উসকে দিয়ে নিজেরা ছাত্রদের ওপর হামলায় অংশ নেন। কেননা জোবরা এলাকা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের আখড়া। তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। ছাত্রদের ওপর হামলায় অংশ নেওয়া আরেকজন চবিরই কর্মচারী অতীশ দীপঙ্কর হলের দারোয়ান বাসাক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সংঘর্ষের মধ্যে ধানক্ষেতে এক শিক্ষার্থীকে রামদা দিয়ে কোপানো ও লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করা ব্যক্তি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের উত্তর জেলা শাখার নেতা। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতাকেও মানুষ জড়ো করে উসকানি দিতে দেখা গেছে।
এ ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, জোবরা গ্রামে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ধানক্ষেতে রামদা দিয়ে কোপানো হয়েছে। চারজনের মধ্যে দুজনের হাতে ছিল লম্বা রামদা, বাকি দুজনের কাছে শক্ত লাঠি। একজন কোপানোর পর ওই ছাত্রকে আরেকজন লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। তার পরনে ছিল টিশার্ট ও প্যান্ট। মাথায় আঘাত করা ওই ব্যক্তি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল মাহমুদ ত্রিশাদ। তিনি ১১ নম্বর পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আহ্বায়ক। রাউজানের এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর অনুসারী।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও স্থানীয় জহির উদ্দিন চৌধুরী টিটু ফেসবুকে বেশ কয়েকটি পোস্ট করেন। এরমধ্যে একটি হলো, ‘প্রিয় জোবরাবাসী, নিজেদের সম্মান রক্ষা করো। দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ শক্তি দেখাও।’ তিনি লোক জড়ো করে ছাত্রদের ওপর হামলার নির্দেশনা দেন বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, শনিবার (৩০ আগস্ট) রাত সাড়ে ১২টার দিকে ২ নম্বর গেটে চবি শিক্ষার্থীদের নানাভাবে ঘটনাস্থলে যেতে বলেন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস) চবি শাখার সদস্য সচিব আল মাশনূন। এছাড়া ওই রাতে তিনি তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর যারা হামলা করেছে এলাকাবাসী। এইটার হিসাব আজকে বরাবর নেবে ছাত্ররা। সবাই ২ নম্বর গেট আসেন।’ তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং হলে থাকা শিক্ষার্থীদের দ্রুত ২ নম্বর গেটে আসার আহ্বান জানান।
রোববার (৩১) দুপুর ১২টায় পুনরায় স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধানোর অভিযোগ উঠেছে চবি বাগছাসের মুখ্য সংগঠক সাব্বির হোসেন রিয়াদ এবং রেজাউর রহমানের বিরুদ্ধে।
সূত্র আরও জানায়, চবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের উসকে দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়া। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়বাদী বৌদ্ধ ফোরামের আহ্বায়ক এবং ক্যাম্পাস সংলগ্ন জোবরা গ্রামের বড়ুয়া পাড়ার বাসিন্দা।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের উসকে দিচ্ছেন উদয় বড়ুয়া। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে কটাক্ষ করেন। এরপরেই দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির (স্যাড) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম ফেসবুকে এক ভিডিওতে বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) রাতের পর আজকের (রোববার) ঘটনায় প্রশাসনের উপস্থিতিতে আমিসহ ২৯ জন শিক্ষার্থীকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, তারা ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে। কিন্তু তার মধ্যে জটলা পাকিয়েছে কিছু উৎসাহী ছাত্রনেতা। আমি নাম মেনশন করছি বাগছাসের সাব্বির রিয়াদ এবং রেজাউর রহমান। এরা ক্যাম্পাসের জুনিয়র ফ্রেশার যারা এসেছে, এদেরকে উসকাতে থাকে—‘রক্তের বদল রক্ত নিতে হবে’। এরা উসকাতে থাকে এবং এলাকাবাসীর দিকে ইট ছোড়ে। আজকের ঘটনা যদি আমি পুরো বিচার করি তাহলে জোবরার মানুষ ছিল ইনোসেন্ট। ওরা সমঝোতায় রাজি হয়েছিল।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ চবি শাখার সদস্য সচিব আল মাশনূন সিটি নিউজকে তার একটি ভিডিও বক্তব্য পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, ‘যতবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থী এবং শিক্ষার্থীদের ওপর আঘাত পড়বে ততবারই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা যাবে, আমিও যাবো। যদি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো আমার ভুল হয়, তাহলে এই ভুল আমি হাজারবার করবো। আগেও করেছি, এখনো করবো।’
বাগছাস নেতা রেজাউর রহমান সিটি নিউজকে বলেন, “গতকালের ঘটনার সত্যতা হচ্ছে এলাকাবাসীদের সঙ্গে যখন প্রশাসন কথা বলতে যায়, তখন প্রো-ভিসি কামাল স্যারের ওপর তারা প্রথমে পাথর নিক্ষেপ করে। আমার একটি ভিডিও অলরেডি যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়। যেখানে আমি সবাইকে নিভৃত হওয়ার কথা বলছিলাম। আমি বলছিলাম, ‘ভাই, আর কয়েকটা মিনিট ওয়েট করেন, আমাদের বোনেরা এলে আপনাদেরকে নিয়ে, আমাদের বোনদেরকে নিয়ে আমরা চলে যাবো’। ওরা প্রো-ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষার্থী ও নিরাপত্তার শাহেদ ভাইদের ওপর যখন হামলা করে, তখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আত্মরক্ষা এবং তাদের শিক্ষকদের রক্ষা করার জন্য পাথর ছোড়া শুরু করে। এখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত।”
চবি বাগছাসের মুখ্য সংগঠক সাব্বির হোসেন রিয়াদ সিটি নিউজকে বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) রাতে কিংবা দুপুর প্রত্যেকটা জায়গায় আমি যাওয়ার আগেই সংঘর্ষ হয়েছে। আমি গিয়েছি আমার কনসার্নের জায়গা থেকে। কেননা আমার ২০-২৫টা ভাই-ব্রাদার একাই আছে। এই কনসার্নের জায়গা থেকে হলেও ওদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আর মানুষকে ডিহিউম্যানাইজ করার যে প্রচেষ্টা, সেটা রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বলে আমি মনে করি। একটা পক্ষ এই ন্যারেটিভ উৎপাদনের জন্য কাজ করছে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক তমজীদ উদ্দিন সিটি নিউজকে বলেন, ‘আমাদের রুমান মুজাহিদ আহত হয়েছে। এই সংঘর্ষের অধিকাংশ জায়গায় তারা (বাগছাস নেতারা) ফুটেজ বিক্রি করতে গিয়ে কিংবা ফুটেজ খাইতে গিয়ে প্রকৃত ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় দিয়েছে। অনেকে বলছে, ফুটেজ বিক্রি করছে। আসলে এটা কথা আর কাজে মিলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি, তাদের দায়বদ্ধতা আছে। তারা ফুটেজ খাইতে গিয়ে ১৫০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।’
চবি ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন সিটি নিউজকে বলেন, ‘এই সংঘর্ষের ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘটনাস্থলে যাই এবং শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করি। আমি নিজেও মবের শিকার হয়েছি। ঘটনা বড় না করে প্রশাসনিকভাবে ডিল করার কথা বলেছিলাম। সেখানে অতি আবেগী কিছু শিক্ষার্থী ঘটনাটা তৈরি করেছিল।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন সিটি নিউজকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে তদন্ত করেনি। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে পারবে। আমি নিজেই আহত হয়েছিলাম। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দায়িত্ব দিয়েছি। উনারা খতিয়ে বের করবে কে কে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর আইনশৃঙ্খলা কমিটি এগুলো শনাক্ত করবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, শনিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটে ভাড়া বাসায় প্রবেশের সময় দারোয়ানের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে মারধরের অভিযোগ করেন নারী শিক্ষার্থী। খবর পেয়ে অন্য শিক্ষার্থীরা ছুটে গেলে গ্রামবাসীর সঙ্গে মধ্যরাতে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এর জেরে রোববার সারাদিন দফায় দফায় স্থানীয় ও চবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। এতে কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা বাহিনী ও সেনাবাহিনীর অন্তত ১০ প্লাটুন সৈন্য। বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সব বিভাগের পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।