• ঢাকা শনিবার
    ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

যুগে যুগে পোশাকের পরিবর্তন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২২, ১১:৪৪ পিএম

যুগে যুগে পোশাকের পরিবর্তন

যুগে যুগে পোশাকের পরিবর্তন

ফিচার ডেস্ক

আদি মানুষ গাছের লতাপাতা বা গাছের ছালের তৈরি পোশাক পরত। কালের বিবর্তনে এর পরিবর্তন ঘটেছে। বহু অঞ্চলের সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়ার মাধ্যমে আমাদেরও ভাষা, চলন কিংবা পোশাকে এসেছে বৈচিত্র্য। এর মূল কারণ হলো অঞ্চল বা ভাষাকে কেন্দ্র করে।

রাজশাহীর উত্তরসূরী - #পোশাক-#পরিচ্ছদ_আবিষ্কারের_ইতিহাসঃ যদি প্রশ্ন করা হয়  যে ঠিক কবে থেকে মানুষ পোশাক পরিধান করা শুরু করলো বা কে আবিষ্কার ...

কোনো জাতির যে সংস্কৃতি ও দীর্ঘদিনের অভ্যাস গড়ে ওঠে, সেটাও সেই জাতির পূর্বপুরুষের চালচলনের স্বাক্ষর বহন করে। এক সময় সেই অভ্যাস বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। তারই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পোশাক।

 

 

বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের দিকে তাকালেই মনে হবে পোশাকে পরিবর্তন কীভাবে হয়েছে। যেদিকেই তাকাবেন দেখবেন ওয়েস্টার্ন পোশাক মানুষের শরীরে জড়িয়ে আছে। এমনকি তাদের পরিহিত কাট-ছাঁট পোশাকের নানা ধরন দেখা যায়।

1500s fashion for Sale OFF 60%

ইতিহাস বলে- মুঘল আমল থেকেই বাংলায় ইউরোপীয় পোশাক আসা শুরু হয়েছিল। তখন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে পশমের পোশাক আসা শুরু হয়। তবে সেগুলো কম মানুষই ব্যবহার করতেন। এই উপমহাদেশে ইংরেজরা আসার পর থেকে পোশাক পরিবর্তন শুরু হয়। কিন্তু পাক-ভারতে ছিল নিজস্ব একটা পোশাক, সৌন্দর্য। সেটি ইংরেজদের আগমনের পর বদলে যায়। এসে যায় এই বাংলায় পোশাক পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

১৮৩৫ সালের সমাচার দর্পণ ও ১৮৪৬ সালে আঁকা এক ছবি থেকে বোঝা যায়, তখনকার সমাজের অভিজাতরা মুঘল বেশভূষাতেই অভ্যস্ত ছিলেন। যদিও ১৮৩১ সালে সংবাদ প্রভাকরের এক প্রতিবেদনে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ‘ফিরিঙ্গি’ পোশাক পরে বলে প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। কিন্তু সেটি ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ওয়েস্টার্ন পোশাকের আলোচনায় মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামটিও চলে আসে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ১৮৪৩ সালের শুরুর দিকে পশ্চিমা বেশভূষায় হিন্দু কলেজে গিয়ে বেশ একটা হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। যদিও মাইকেল নিজেই এরপর সেই পোশাক পরে কলেজে যাতায়াত করেছেন কি না, তার কোনো উল্লেখ নেই।

১৯ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পুরুষদের মধ্যে পশ্চিমা পোশাকের প্রচলন বৃদ্ধি পায়। তখনকার সময়ে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত থাকায় অনেকেই কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষা নিতে যেতেন। অনেকে ইংল্যান্ডে যেতেন। তারা বিদেশে যেসব পোশাক পরে অভ্যস্ত ছিলেন, দেশে এসেও সেই পোশাকই পরতেন।

কিন্তু পশ্চিমা পোশাক জনমানুষের পোশাক হয়ে উঠতে পারেনি তখনও। কারণ সবাই বলত, এ পোশাক বিলাসিতা বা আভিজাত্যেরই একটা প্রতীক। এটা কোনো সম্মানজনক পোশাক নয়। তবে গলাবন্ধ কোটের কথা না বললেই নয়, কারণ ১৮৮০-৯০ সালের মধ্যে তোলা কয়েকটি ছবিতে খোদ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই তা পরে ছিলেন, যার চল ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন রাজপরিবার ও অন্যান্য অভিজাত পুরুষদের মধ্যে।

১৯৩০ সালের আগে কোট ছাড়া প্যান্ট পরার চল থাকার সম্ভাবনা তেমন ছিল না। তবে পশ্চিমা জামা স্থান পাওয়া শুরু করে ২০ শতকে এসে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এক মিছিল আর ১৯৪১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিছিলের দুটি ছবি যদি তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে ১৯০৫-এর তুলনায় ১৯৪১ সালে শার্টের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও স্যুট-টাইয়ের ব্যবহার অনেকাংশেই বেড়ে যায়।

ওই সময়ে অভিজাতদের মধ্যেও শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ-পেটিকোট পরার রীতি ছিল না। তবে ইংরেজ শাসন বা ভারত ভাগের পরও বাংলায় পুরুষদের ধর্মপরিচয় নির্ণয় করা যেত তাদের পরনের পোশাক দেখে। তবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি নারীরা শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজ পরতেন।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর দেশীয় ফ্যাশনে বড় আকারের পরিবর্তন আসে। নতুন দেশের পরিস্থিতি কিছুটা থিতু হয়ে আসার পর পশ্চিমা সিনেমা-গান প্রবেশ করে আমাদের সংস্কৃতিতে। এখন অভিনয় করতে গিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক ব্যবহার শুরু হয়। বদলে যায় স্টাইল। সাজসজ্জায় প্রতিদিন পরিবর্তন আসতে থাকে। আর সব হাল ফ্যাশনের কিশোর-কিশোরীরা তা অনুকরণ করতে শুরু করেন। মাথার চুল, কথা বলার ধরনেও। এর ফলে সিনেমা আর শিল্পীদের পরিচ্ছদেও পরিবর্তন আসতে থাকে।

ডেনিম জিন্সের উত্থান, ১৯৫০ সালের দিকে ‘ব্যাড বয় জিন্স’-এর কাটতি আর নায়কদের অনুকরণপ্রিয়তা- সব মিলিয়ে পোশাক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল সে সময়। ১৯৬০-এর দিকে যখন হিপ্পি আন্দোলন শুরু হলো, আমেরিকায় তখন একটা বিরাট সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দেখা দেয়। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া এসে লাগে বাংলাতেও। পাকিস্তান আমলের বেলবটম প্যান্ট পরা যুবক আর নায়কদের ছবি তারই প্রমাণ দেয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই চল অব্যাহত ছিল। ক্রমে ক্রমে আধুনিকতা স্পর্শ করতে থাকে সব দিকে। পরিবর্তন হতে থাকে সবকিছুতেই।

১৯৭০ সাল থেকেই অভিজাত ও ধনী তরুণীরা ডেনিমের স্কার্ট আর ভেস্ট পরতে পছন্দ করতেন। ১৯৮০-তে ডিজাইনার জিন্স আর ১৯৯০-এ ‘গ্রাঞ্জ’ মিউজিকের বদৌলতে আপাদমস্তক জিন্সের পোশাকও চলেছিল দেশে। ২০০০ সালের পর ব্রিটনি স্পিয়ার্সের মতো পপতারকাদের প্রভাবে স্কিনি জিন্সের যে চল শুরু হয়েছিল শহুরে আধুনিক তরুণীদের মধ্যে তা এখনও চলছে। তবে আর সেটা কোনো সুপারস্টারের অনুকরণে নয়, একেবারে নিজস্ব অভ্যাস হিসেবেই। সেই সঙ্গে কুর্তি, প্লাজো, শেমিজ, ফতুয়া-ফ্যাশন অনুষঙ্গগুলোতে পরিবর্তন এসেছে বেশ ক’বার। কখনও হলিউড কিংবা বলিউড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বা কখনও সরাসরি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

নারীরা শুধুই যে পশ্চিমা পোশাক পরেছেন তা নয়, বরং দেশি শাড়ি কিংবা সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে পশ্চিমা আনুষঙ্গিক মিলিয়ে নিজেরাই তৈরি করেছেন ফ্যাশনের নতুন ধারা। আর জ্যাকেট, হুডি, স্যুটের মতো ওয়েস্টার্ন পোশাকগুলো তো নারী-পুরুষ উভয়েই এখন পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

বর্তমান সময়ের এসব পোশাক ওয়েস্টার্ন হিসেবে পরিচিত হলেও প্যান্ট, শার্ট, কোট, জিন্স, টি-শার্ট, টপস, স্কার্ট এখন আমাদের নিজস্ব পোশাকে পরিণত হয়েছে। বরং নিজেদের মতো করে নকশার পরিবর্তন ঘটিয়ে পোশাককে আরও নতুন নতুন ডিজাইনে করছে। আসছে সময়ে হয়তো আরও নতুন নতুন পোশাকের আগমন ঘটবে। বর্তমানে কিছু পোশাক সমাজে নিন্দনীয় হয়ে উঠলেও যুবক-যুবতীদের কাছে আধুনিক বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্যান্ট কাটা, শার্ট ছোট। কিশোরীদের ব্লাউজ কিংবা পরনের গেঞ্জি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। তাদের কাছে আধুনিক হলেও অন্যদের কাছে নগ্ন পোশাকে পরিচয় পাচ্ছে। এই পোশাক বহুদূর ঠেলে দিয়েছে বর্তমান সমাজকে এবং মানুষকে। উত্তেজনাকর পোশাক অনেক কিছু ইঙ্গিত করে- যা খুন, ধর্ষণ পর্যন্ত করতে সহায়তা করছে। ফলে আজকের এই পোশাকগুলো হয়তো নিজস্ব সংস্কৃতি হয়ে উঠবে।

 

সাজেদ/

আর্কাইভ