• ঢাকা শনিবার
    ০৩ মে, ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২
বিবিসির বিশ্লেষণ

ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় কার লাভ কার ক্ষতি?

প্রকাশিত: মে ২, ২০২৫, ০২:২১ পিএম

ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় কার লাভ কার ক্ষতি?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন বেড়েছে বাংলাদেশের। গত কয়েক মাস ধরে চলা মৌখিক দ্বন্দ্বের পর প্রতিবেশী ভারত-বাংলাদেশ সম্প্রতি পরস্পরের বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যার সম্ভাব্য প্রভাবের জন্য এখন প্রস্তুত হতে হচ্ছে দুদেশকেই।

সস্তা আমদানিতে দেশি শিল্পগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য গত মাসে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করে বাংলাদেশ। তার আগে হঠাৎ ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেয়। ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় বাংলাদেশকে তার পণ্য তৃতীয় দেশে রপ্তানি করতে ভারতীয় বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দিচ্ছিল। নিজেদের বন্দরগুলোতে ‘জট’ তৈরি হচ্ছে, এমন অজুহাতে এই সুবিধা বন্ধ করে দেয় দেশটি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। বর্তমানে ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন তিনি। আর শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে বিচার করার জন্য তাকে দেশে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়ে আসছে ঢাকা। হাসিনা তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দিল্লি এখনো এ দাবিতে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলার অভিযোগ নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা করেছে ভারত। যদিও তা বরাবরই অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ। সরকার বলেছে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বেশির ভাগ ঘটনার পেছনে ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা সেগুলো ছিল সাধারণ অপরাধের ঘটনা। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুসারী ১০ শতাংশের কম।

প্রতিবেশী এ দুই দেশ যখন পরস্পর বিবাদে জড়াচ্ছে, তখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির হিসাব কষছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে বিচার করার জন্য তাকে দেশে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়ে আসছে ঢাকা। হাসিনা তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দিল্লি এখনো এ দাবিতে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

বাংলাদেশের পোশাক কারখানার জন্য অত্যাবশ্যক সুতা এখনো সমুদ্র ও আকাশপথে আমদানি করা সম্ভব। কিন্তু এ পথে সময় ও খরচ বেশি। ভারত ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন (১৬০ কোটি) ডলারের সুতা রপ্তানি করে। এর এক-তৃতীয়াংশ স্থলবন্দর দিয়ে।

বর্তমানে স্থগিত হওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য তৈরি পোশাক সড়কপথে ভারতের বিভিন্ন শহর হয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পথ খুলে দিয়েছিল।

এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেন, ‘এটি (বাংলাদেশের দ্রুত-ফ্যাশন রপ্তানি শিল্পের জন্য) একটি ধাক্কা।’ প্রতিষ্ঠানটি জারার মতো ব্র্যান্ডের জন্য পণ্য পরিবহন করে। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় পথ ব্যবহার করে মালামাল এক সপ্তাহে পশ্চিমা দেশগুলোতে পৌঁছাত। সমুদ্রপথে তা আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নেয়।’

চীনের পর বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। গত বছর ৩৮ বিলিয়ন (৩ হাজার ৮০০ কোটি) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে দেশটি। এর মধ্যে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি ভারতের স্থল ও বিমানপথ ব্যবহার করে রপ্তানি করা হয়েছে, যা আনিস আহমেদের মতে ছিল বেশ কার্যকর।

বাংলাদেশের সীমিত বিমান পরিবহনক্ষমতা এবং সরঞ্জাম ও সুযোগ-সুবিধার ঘাটতিতে থাকা বিমানবন্দর সরাসরি রপ্তানিতে এক বড় প্রতিবন্ধকতা। অনেকে মনে করেন, সম্প্রতি চীন সফরে মুহাম্মদ ইউনূসের করা মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করেছে।

অধ্যাপক ইউনূস ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য বাংলাদেশকে ‘সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন ও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এ অঞ্চল ‘চীনা অর্থনীতির একটি সম্প্রসারণ’ হয়ে উঠতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেতারা এ মন্তব্যকে ‘আক্রমণাত্মক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

মুহাম্মদ ইউনূসের এ মন্তব্য চীনের সঙ্গে সীমান্তে ভারতের কৌশলগত ঝুঁকি বা দুর্বলতা তুলে ধরেছে। আর এটিই দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করেছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মাত্র ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত শিলিগুড়ি করিডোর (‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত) দিয়ে যুক্ত, যা নেপাল ও বাংলাদেশবেষ্টিত এবং তিব্বতের চুম্বি উপত্যকার সন্নিকটে অবস্থিত।

বেইজিং-নয়াদিল্লি সীমান্ত উত্তেজনার ইতিহাস ও ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের কারণে দেশটির প্রতিরক্ষা খাতের পরিকল্পনাকারীদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে কোনো সংঘাত বাধলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভারতের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চীন ওই করিডরকে নিশানা বানাতে পারে।

বাংলাদেশি বিশ্লেষকেরা বলছেন, অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল, আঞ্চলিক যোগাযোগের উন্নয়ন। কেননা, মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের সময় ১০০ কোটি ডলারের তিস্তা নদী প্রকল্পে বেইজিংয়ের আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে ঢাকা।

উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বাংলাদেশের পোশাক আমদানির ওপর স্থলপথে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে। বাংলাদেশি বিশ্লেষকেরা বলছেন, আরও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আত্মঘাতী হতে পারে।

ভারতীয় বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, কৌশলগত শিলিগুড়ি করিডরের কাছাকাছি প্রকল্পে চীনের সংশ্লিষ্টতা দিল্লিকে অস্থির করে তুলতে পারে।

তবে দুই দেশের (বাংলাদেশ-ভারত) সম্পর্কের অবনতিতে উভয় পক্ষেই উদ্বেগ রয়েছে।

ভারত ভিসা–সংক্রান্ত নিয়মকানুনে কড়াকড়ি করায় বাংলাদেশে অসন্তোষ বাড়ছে, বিশেষ করে হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ভিসার অনুমোদন অনেক কমে গেছে। আগে বছরে প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি ভারত সফর করতেন ভ্রমণ, ব্যবসা, শিক্ষা ও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। ভারতের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মতে, গত কয়েক মাসে দৈনিক ভিসা ইস্যুর হার ৮০ শতাংশের বেশি কমে গেছে।

আবার, হাসিনার ভারতে অবস্থান ও তাকে প্রত্যর্পণের দাবি এক বড় অস্বস্তির বিষয় হয়ে আছে।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্যাম শরণ বলেন, ‘তাদের (বাংলাদেশি) বোঝা উচিত যে আমরা হাসিনাকে সহজে তুলে দিতে পারি না। আমরা জানি, তাকে তুলে দিলে তার কী পরিণতি হবে। আমি মনে করি, ভারতীয় জনমতও সেটি সমর্থন করবে না।’

উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বাংলাদেশের পোশাক আমদানির ওপর স্থলপথে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে। বাংলাদেশি বিশ্লেষকেরা বলছেন, আরও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আত্মঘাতী হতে পারে।

‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে এখন একটি দৃঢ় মতামত তৈরি হচ্ছে যে আগের (হাসিনা) সরকার ভারতকে (দেশটির উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য) যে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছিল, আমাদেরও উচিত সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা’, বিবিসিকে বলেন ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করতে বাংলাদেশের বন্দর, সড়ক ও জলপথ ব্যবহার করে। এতে সময় ও খরচ কমে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, এই পথে প্রত্যাশিত পরিমাণে পণ্য পরিবহন হচ্ছে না।

এদিকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে।

এক সময়কার পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৫ বছরের শাসনকালে হাসিনা পাকিস্তান থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন।

গত মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ ঢাকা সফর করেছেন। পাকিস্তানের তরফে ১৫ বছরে বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম কোনো উচ্চপর্যায়ের সফর। গত সপ্তাহে ভারতনিয়ন্ত্রত কাশ্মীরে এক হামলার ঘটনায় নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ায় পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের এক পরিকল্পিত সফর অবশ্য স্থগিত হয়েছে।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক শ্যাম শরণ বলেন, ‘আমি মনে করি না যে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ নিয়ে কোনো উদ্বেগ আছে। তবে যদি এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তারা একত্রে কাজ করে ভারতের জন্য সমস্যা তৈরি করতে চায়, সে ক্ষেত্রে সেটি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হবে।’

দুই দেশের সরকারের তীব্র প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ ও ভারতের জনমতেও প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। অন্যদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ‘ইসলামপন্থী’ হুমকি অতিরঞ্জিত করে দেখানোর অভিযোগ করা হচ্ছে।

দীর্ঘ কয়েক বছরে গড়ে ওঠা (দুই দেশের) জনগণের সম্পর্ক দৃশ্যত এখন ক্ষয়ের দিকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, উভয় পক্ষ শান্ত থাকতে ব্যর্থ হলে, তাদের পদক্ষেপ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।

জাতীয় সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ