• ঢাকা সোমবার
    ১৬ জুন, ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

বিজ্ঞানীরা কেবল সতর্ক করছেন, কিন্তু সমাধান কী

প্রকাশিত: মে ৫, ২০২৩, ০৫:০৫ পিএম

বিজ্ঞানীরা কেবল সতর্ক করছেন, কিন্তু সমাধান কী

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ ছিল না। কিন্তু সেই আশা দ্রুতই ফিকে হতে শুরু করেছে। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরাই এর বিপজ্জনক দিক নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তারা কেউই এই সমস্যা সমাধানের কথা বা উপায় বলে দিচ্ছেন না।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা এআই নিয়ে সর্বশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কয়েক দশক ধরে কাজ করা বিজ্ঞানী যিনি কিনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘গডফাদার’ বলে খ্যাত সেই জিওফ্রে হিনটন। এমনকি তিনি এর বিপজ্জনক দিক নিয়ে স্বাধীন ও মুক্তভাবে কথা বলার জন্য গুগলের চাকরিই ছেড়ে দিয়েছেন।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে বুধবার (৩ মে) এক সম্মেলনে এআই এর গডফাদার জিওফ্রে হিনটন বলেন, ‘যখন স্মার্ট জিনিসগুলো আমাদের বুদ্ধিমত্তাকেই ছাড়িয়ে যায় তখনই মানব প্রজাতির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে।’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের সীমারেখা প্রসঙ্গে হিনটন বলেন, ‘আমরা হয়তো বড়জোর আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সচল রাখার জন্য এটিকে (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে) কিছু সময়ের জন্য ব্যবহার করেত পারি কিন্তু এর বেশি নয়।’
 
কেবল হিনটনই নন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবক স্যাম অল্টম্যান। তিনি বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজ কেড়ে নিতে পারে, গুজব ছড়াতে পারে এমনকি নিজের ইচ্ছায় সাইবার আক্রমণ পর্যন্ত করতে পারে। তাই দিনে দিনে এ প্রযুক্তির বিকাশকে ধীরগতির করতে হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন টেসলার প্রধান ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কও। তার মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘বিপজ্জনক প্রযুক্তি’ এবং ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন তদারকির জন্য এবং এটি জনস্বার্থে কাজ করছে তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের এক ধরনের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপক্ষে বিজ্ঞানী উদ্যোক্তাদের বাইরে আওয়াজ তুলেছেন বিশ্ব নেতারাও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমনকি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম আরও বিপজ্জনক চিত্র হাজির করেছে আমাদের সামনে। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের স্থান দখল করায় অনেক গতানুগতিক কাজ মানুষের হাতছাড়া হবে এবং এ কারণে আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বে অন্তত ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে।
 
কিন্তু এত আশঙ্কার পরও বিজ্ঞানীরা কেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপদের সমাধান দিচ্ছেন না। এর একটি সহজ উত্তর হতে পারে, এই বিপদের সমাধান এখনও তাদের আওতায় নেই। এ বিষয়ে জিওফ্রে হিনটনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ম্যাসাচুসেটসের সেই সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এই জিনিসগুলো (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) আমাদের কাছ থেকেই শিখেছে। যেমন বিভিন্ন উপন্যাস কিংবা ম্যাকিয়াভেলির লেখা পড়ে এগুলো জানতে পারছে কীভাবে মানুষকে ম্যানিপুলেট করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও এগুলো সরাসরি যান্ত্রিকভাবে সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না কিন্তু এগুলো আমাদের (মানুষের চিন্তা জগৎকে) নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’

বক্তব্যের একপর্যায়ে হিনটন বলেন, ‘আমি চাই যে, আমার কাছে এই সমস্যার একটি সুন্দর সহজ সমাধান থাক যা প্রয়োগ করে বিষয়টি আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমার কাছে তা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই যে আমাদের সামনে কোনো সমাধান রয়েছে।’

হিনটনের কথায় আত্মসমর্পণের সুর স্পষ্ট। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে ‘গডফাদার’ হলেও তার সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবিকাঠি এখনো তার হাতেই নেই। তবে একটি সমাধান হতে পারে স্যাম অল্টম্যানের মন্তব্য অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে মুনাফামুখী প্রতিষ্ঠানগুলো কেন কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফার সুযোগ এত সহজে ছেড়ে। ফলে যতই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের কথা বলা হোক না কেন তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

সবাই হিনটনের মতো এতটা হতাশাবাদীও নন। তাদের মধ্যে একজন হলেন সহযোগী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জগতের অন্যতম দিকপাল জোশুয়া বেনজিও। সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে তিনি বলেছেন, চ্যাটজিপিটি এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি নিয়ে হিনটনের উদ্বেগ যথার্থ। তবে তিনি যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, ‘আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত’, বাস্তবতা ততটাও কঠিন নয়।’
 
মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেনজিও আরও বলেন, ‘আমাদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, তিনি হতাশাবাদী ব্যক্তি এবং আমি আশাবাদী। আমি মনে করি, আমাদের সামনে এ সংক্রান্ত যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিপদ রয়েছে তা কেবল কয়েকজন গবেষক নয় বরং সরকার এবং জনসাধারণকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।’

বেনজিও আশাবাদী হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কারণ, বিজ্ঞানীরা এখনো পরিষ্কার নন যে, আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এআই এরই মধ্যে তথ্য জাল করাসহ নানা অপরাধমূলক কাজ করে বিপদের আভাস দিয়েছে। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তথ্য জমা করে রাখার দক্ষতা মানুষের বেশি হওয়ায় তা সরাসরি মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কেবল তথ্য সংগ্রহ করে রাখাই নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এরই মধ্যে বিশ্লেষণী দক্ষতাসহ মানুষের বিভিন্ন দক্ষতার সমকক্ষ হয়ে ওঠার প্রবণতা এবং প্রমাণ দেখিয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিপ লার্নিং পদ্ধতির অন্যতম উদ্যোক্তা এবং গুগলের সাবেক কর্মকর্তা আদিয়ান গোমেজ এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ হতে পারেন। গোমেজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগে উৎসাহী কিন্তু তিনি ভয় পান যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত ক্ষমতা ‘বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন’ হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে যেখানে ‘কল্পনা এবং যুক্তির ক্ষেত্রে তা মানুষকেও হার মানাতে পারবে।’  

 
আদিয়ান গোমেজ বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই মডেলগুলো কোনোভাবে পারমাণবিক অস্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ নেবে এবং মানব প্রজাতির বিলুপ্তি ডেকে আনবে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে তা হয়তো নয়।’ তিনি আরও বলেন, তবে এটি বাস্তব যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেসব বাস্তববাদী নীতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে যা সত্যিকার অর্থেই ভালো কিছু করার চেষ্টা করছে।’

আদিয়ানের কথা আমলে নিলে আমাদের শঙ্কিত হতেই হয়। তবে সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকপাল তাদেরই অজানা থাকা যে, আসলে ঠিক কী ধরনের বিপদ আমাদের সামনে হাজির হতে পারে। ফলে এখানে সতর্ক হওয়ার সুযোগ কম থাকছে। তবে আশার বিষয় হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এরই মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভাবছেন। এর ব্যবহার, প্রয়োগ, বিপদ এবং নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করছেন। এ অবস্থায়, আমাদের সামনে একটি পথই খোলা রয়েছে আর তা হলো, মানব ইতিহাসের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের সময় মানুষ যেমন সামলে নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে তেমনি এবারও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাজির করা বিপদও সামলে নেবে তার ওপর ভরসা রাখা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর তার স্রষ্টা মানুষের বুদ্ধিমত্তাই বিজয়ী হবে তার ওপর ভরসা রাখা।


এডিএস/

আর্কাইভ