• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৯ মে, ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

দালালের ভারে ভারাক্রান্ত শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২১, ০৩:১২ এএম

দালালের ভারে ভারাক্রান্ত শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

মাদারীপুর প্রতিনিধি

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হওয়া মাত্রই হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র কেড়ে নেন দাদালরা। পরে ব্যবস্থাপত্র দেখেই দালালরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম বলে দেন। তাদের ক্লনিকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘এই পরীক্ষাটা শুধু সেখানেই করা হয়। এমনটিও বলে দেন রোগীদের।’ এভাবেই প্রতিনিয়ত শিবচর  উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা হয়রানির শিকার হন। এমন অভিযোগ শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা প্রায় সকল রোগীর।

উপজেলার ১৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাসহ আশপাশের জাজিরা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বাসিন্দারা উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এলাকার ভুক্তভোগী রোগীরা জানান, শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স জনবল সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। এখানে কর্মরত দক্ষ লোকের অভাব। কিন্তু এখানে কর্মরত ডাক্তার সবাই যেন অনভিজ্ঞ। ক্লিনিকে গেলে এরাই সুনামধন্য ডাক্তার বলে যান। ডাক্তাররা ক্লিনিকে গেলে সিজার থেকে শুরু করে সব ধরনের জটিল রোগের চিকিৎসা করেন। এক কথায় শিবচরের ১০ থেকে ১২টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এসব ডাক্তারই পরিচালনা করেন। ক্লিনিকগুলোতে এক্সরে-আলট্রাসনোগ্রাম, বিভিন্ন ধরনের রক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অহরহ প্রসূতি মায়েদের সিজার করানো হয়। কিন্ত শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজার হয় না প্রায় ১০-১২ বছর ধরে।

অথচ শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার শশাংক চন্দ্র ঘোষ নিজেই বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী দেখেন। তিনি প্রায়ই শিবচর বাজারের মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখেন। সেখানে সিজার থেকে শুরু করে সকল রোগের চিকিৎসা দেন একমাত্র তিনিই। ওই হাসপাতালের মালিক শারমিন আক্তারের সঙ্গে তার পার্টনারশিপের ক্লিনিক ব্যবসা রয়েছে বলে এলাকায় ব্যাপকভাবে মুখরোচক গল্প শোনা যায়।

তাই যিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজেই যখন অনিয়মে জড়িত সেখানে বিভিন্ন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক বলে দাবি করেন এলাকার সচেতন মহল। দিন দিন দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় রোগীরা আরও বেশি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। দালালদের রোগী টানাটানিতে প্রায়ই ঘটছে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা। তবুও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।


শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগী মাহবুবুল আলম জানান, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা সব সময় হাসপাতালের অভ্যন্তরেই ঘোরাঘুরি করে। অনেকে আবার হাসপাতালের ডাক্তারের চেম্বারের মধ্যে অবস্থান করে। চিকিৎসকেরা সাধারণ রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দিলেই এসব দালাল পাগল হয়ে যায় তাদের প্রতিষ্ঠানে নেয়ার জন্য। এতে তাদের হাতে রোগী ও স্বজনদের নাজেহাল হতে হয়।

কাঠালবাড়ি এলাকা থেকে আসা হাসাপাতালের রোগী ফয়জুল শেখ- অভিযোগ করে জানান, শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লক্সের শৌচাচাগারের বেহাল দশা। রোগী ভর্তি হলে এখানে এক দিন থাকলে নিজেই রোগী হয়ে যায়। 

ভর্তিকৃত রোগী বাবুল খা জানান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তিন-চার দিন পর আসে। হাসপাতালে গন্ধে থাকা যায় না। কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

ভুক্তভোগী রোগী আশ্রাফ আকনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা গেছে, শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের আনাগোনা। অনেকেই চিকিৎসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চেম্বারের মধ্যেও অবস্থান করেন। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা রোগীদের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। তবে ডাক্তাররা যে পরীক্ষার নামই লিখুক না কেন নিজেদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিকে রোগীদের পাঠাতে বাধ্য করেন।

মাদারীপুর জেলা পরিষদের সদস্য আয়শা সিদ্দিকা জানান, আমাদের উপজেলার ১৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ও আশপাশের জাজিরাসহ মাদারীপুর সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বাসিন্দারা উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উপজেলার সর্বত্র অবকাঠামো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যোগাযোগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নত হলেও এখানকার স্বাস্থ্যসেবার করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। হাসপাতালটি বেশ কিছুদিন আগে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও কমে গেছে। হাসপাতালটি নিজেই নানা দোষে রুগ্ন হয়ে গেছে। কোনো রাগী আসলে ডাক্তার  রেফার্ড করে দেন অন্য হাসপাতালে। পাঠিয়ে দেন তাদের পছন্দমতো ক্লিনিকে। ডাক্তাররা কোনো দায়িত্বই নেন না।

শিরুয়াইল থেকে রোগী বজলুর রহমান জানান, প্রায় প্রতিদিনই শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবস্থান নেয়া থাকে কয়েকটি নির্দিষ্ট দালাল সিন্ডিকেট। এদের সঙ্গে ডাক্তারদের যোগসাজশ রয়েছে। কারণ প্রায় সকল ডাক্তারই বাজারের কোনো না কোনো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বসে রোগী দেখেন। বিনিময়ে এসব দালালের পকেটে পুরে দেন কমিশনের নগদ টাকা। আর প্রতিদিনই তাদের খপ্পরে পড়ে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ রোগীরা।

খানকান্দি গ্রামের রাজু খান জানান, হাসপাতালের সামনের গেটে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক রাখা থাকে। রোগী পাঠানোর ক্ষেত্রে এদের অতিরিক্ত ভাড়ায় যেতে হয় রোগীদের। আর অতিরিক্ত আদায় করা ভাড়া থেকেও কমিশন নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

অফিস সূত্র জানায়, শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লক্সে প্রায় ২৭ জন ডাক্তার কর্মরত আছেন। এছাড়া সিস্টার ২৪ জন, অফিস সহকারী ৩ জন, ইপিআই ২ জন, সুইপার ১ জন, এমএলএসএস ২ জন, ঝাড়ুদার ২ জন।


হাসপাতালের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লক্সের হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রতিদিনই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং চক্রের ১০-১৫ জন সদস্য সক্রিয় থাকে। শিবচরের প্রায় ১৮ থেকে ২০টি ক্লিনিক  রয়েছে। হাসাপাতালের ডাক্তাররাই  ওই সকল ক্লিনিকে গিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে ক্লিনিক মালিকদের উজ্জীবিত করে রাখেন।

অপরদিকে রাজধানীর নামী-দামি হাসপাতালের নামে এখানে শিবচরে অনেক হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীর স্বনামধন্য হাসপাতাল- পপুলার, মেডিপ্যাথ, ইবনে সিনা, স্কায়ার, ল্যাবএইড, মেডিনোভা ইত্যাদি নামের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্লিনিকের দালাল বলেন, ‘নিজেদের পছন্দসই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী টানতে গিয়ে অনেক সময় এ দালালদের মধ্যে তৈরি হয় ঝগড়া-বিবাদ। পরে আবার হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সরা সেসব সমস্যা সমাধানও করে দেন।’

অভিযোগের সত্যততা স্বীকার করলেও হাসপাতাল প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এ ব্যাপারে বক্তব্য দিতে রাজি হননি হাসপাতালে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার জানান, দালালদের উৎপাতের বিষয়টি একাধিকবার হাসপাতাল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের নজরে দিয়েও সমাধান হয়নি। এমনকি ক্লিনিক মালিক পক্ষের সঙ্গেও আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবাই কথা দিয়েও কথা রাখেনি। এদের উৎপাতে চিকিৎসাসেবা অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে।’

শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. মিঠুন বিশ্বাস জানান, হাসপাতালের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করে এমন ছেলে-মেয়েদের প্রায়ই দেখা যায়। ক্লিনিকের দালালদের দৌরাত্ম্য চরম আকার ধারণ করেছে। আমরা কয়েকবার এর সমাধান করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ক্লিনিক মালিকদের কোনোভাবে দমানো যায় না। আর ক্লিনিক চালিয়ে রাখেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারেরা। এখানকার ডাক্তারেরা ক্লিনিকে গেলেই তো অভিজ্ঞ ডাক্তার হয়ে যান। তবে অনেক সময় দালালরা এসে আমার সঙ্গে চেম্বারে চোখাচোখি হলে তারা সালাম দিয়ে কেটে পড়ে।

শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘হাসপাতালে দালাল, এই অভিযোগ শুনেছি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জড়িত দালালদের প্রবেশ নিষেধ করা হবে। তবে দালাল নির্মূল করা আমার একার দায়িত্ব না। অফিস সময়ের বাহিরে কোনো ডাক্তার ক্লিনিকে গেলে আমার কিছু করার নেই। অফিস টাইমের বাইরে কোথায় কে কী করল? তা দেখার দায়িত্ব আমার নয়। ডাক্তাররা ক্লিনিকে বা অন্য কোথাও প্রাকটিস করতেই পারে।’

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘একজন সুইপার কাজ করে। এ ব্যাপারে অনেকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছি না।’   

এস/এম. জামান

আর্কাইভ