• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২৩, ০৩:২১ পিএম

রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ভারতের বর্তমান বিরোধী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর পাশে হাঁটছেন হাজারো সাধারণ মানুষ। মুখভর্তি দাঁড়ি আর সাদা টি-শার্ট পরেই দিনের পর দিন হেঁটে চলেছেন তিনি। গত কয়েক মাসে তিনি যা করেছেন, তাতে একরকম স্তম্ভিত ভারতের শাসক দল বিজেপি।
কদিন আগেও যে রাহুল গান্ধীকে ‘পাপ্পু’ বলে সম্বোধন করছিলেন সমালোচকরা, ইমেজ সংকটে থাকা সেই পাপ্পুই এখন হয়ে উঠেছেন পরিশুদ্ধ ভাবমূর্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হয়ে উঠছেন একজন পরিণত রাজনীতিবিদ। রাহুল গান্ধী কিছুই বলেননি, শুধুই হেঁটেছেন। কংগ্রেস বলছে, ক্ষমতাসীন বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে পুরো ভারত। সেই বিভক্ত দেশকে একতাবদ্ধ করতেই ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা শুরু করেছেন রাহুল, হেঁটে চলেছেন মাইলের পর মাইল। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে ভারতকে রক্ষায় তিনি শুনতে চান মানুষের কথা। সেই লক্ষ্যে ভারতের কন্যাকুমারী থেকে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর হাঁটা শুরু করেন রাহুল। এরইমধ্যে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার পথ।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৩০ কিলোমিটার করে হাঁটছেন রাহুল। প্রতিদিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুতি নেন হাঁটার। চুল-দাড়িও কাটছেন না দীর্ঘদিন। হাঁটার সময় পরনে থাকে সাদা টি-শার্ট। রাহুল যখন হাঁটা শুরু করেন তাকে দেখতে লাগে ঠিক তপস্বীর মতোই। এমনই মন্তব্য করেছেন কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ।
তার কথায়, ‘রাহুল গান্ধী সুপারহিউম্যান। আমরা যেখানে শীতে কাবু হয়ে জ্যাকেট পরতে বাধ্য হয়েছি, সেখানে রাহুল গান্ধী শুধু একটি টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে ভারত জোড়ো যাত্রায় হাঁটছেন। তিনি এক যোগী। তিনি নিজের তপস্যায় মনোনিবেশ করেছেন।’
তীব্র শীতের মধ্যে শুধু একটি কার্গো প্যান্ট এবং টি-শার্ট পরায় রাহুল গান্ধীকে নিয়ে কটু মন্তব্য করতে ছাড়েনি সমালোচক এবং বিজেপি নেতারা। তবে বিজেপির কটাক্ষের জবাবে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘আপনারা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন যে আমার ঠান্ডা লাগছে কিনা। কিন্তু কখনও জানতে চান না যে একজন কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র শিশুদের ঠান্ডা লাগে কিনা। যারা দরিদ্র মানুষদের গরম পোশাক দেয়ার মতো সামর্থ্য রাখে না, তাদের মুখে এসব কথা মানায় না।’
ভারত জোড়ো যাত্রা আসলেই বিজেপিকে কতটা ধাক্কা দিয়েছে তা বোঝা যায় স্বয়ং কংগ্রেসবিরোধী স্বরাজ ইন্ডিয়া পার্টির নেতা যোগেন্দ যাদবের কথায়। যোগেন্দ্র কংগ্রেস বিরোধী হলেও যোগ দিয়েছেন রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রায়। প্রথম থেকে তিনি রয়েছেন রাহুলের সঙ্গে, পৌঁছেছেন কাশ্মীর পর্যন্ত।যোগেন্দ্র যাদব বলেন, ‘ভারত সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে, তাতে বাকি সব ঢাকা পড়ে গেছে। এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বিষয় ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভিত অটুট রাখা। সংবিধান প্রতিদিন লঙ্ঘিত হচ্ছে। স্বাধীনতাসংগ্রাম ও দক্ষিণ এশীয় সভ্যতার মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র আজ প্রবল সংকটের মুখে। এই অবস্থায় ক্ষুদ্র রাজনৈতিক সংঘাত আমার কাছে অর্থহীন। বাড়িতে যখন আগুন লাগে, তখন সেটা নেভানোই সবচেয়ে বড় কাজ। কে কোন রঙের বালতি ভরে পানি আনছে, কার সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ, সেসব ভাবা তখন অপ্রাসঙ্গিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস পার্টি এই অধঃপতন রুখতে উদ্যোগী হয়েছে। ঘৃণা ও মিথ্যার রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই কারণে দ্বিধাহীন চিত্তে এই যাত্রায় সঙ্গী হয়েছি। এর অর্থ এই নয় যে আমরা কংগ্রেস কিংবা রাহুল গান্ধীকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছি। কংগ্রেসের বিরোধিতা আগে করেছি, প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও করব। কিন্তু এই সন্ধিক্ষণে নয়।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, রাহুল গান্ধী তার ভারত জড়ো যাত্রা নিয়ে যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী এবং ছাত্র, গৃহকর্মী, কর্মজীবী, তরুণ, বৃদ্ধসহ হাজার হাজার মানুষ যোগ দিচ্ছেন। এই আমজনতার সঙ্গে কথা বলেছে দেশটির কয়েকটি গণমাধ্যম। তাদের ভাষায়, কংগ্রেস সমর্থক না হলেও অনেক সাধারণ মানুষ রাহুল যা বলছেন তা ফেলে দিতে পারেননি।
রমা শ্যাম নামে এক জনস্বাস্থ্যকর্মী তার স্বামী মাসুদ আখতার ও ১১ বছর বয়সী ছেলে কবিরকে নিয়ে ভারত জোড়ো যাত্রায় যোগ দেয়ার জন্য মুম্বাই থেকে দিল্লি পৌঁছান। রমা শ্যাম জানান, এই আন্দোলনটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের অংশ হওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।
সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা দুর্ভাগ্যবশত মুম্বাই যায়নি। আমরা এই ইতিবাচক আন্দোলনের অংশ হতে চাই। গত সাত-আট বছর ধরে অনেক বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এই আন্দোলনটি আমাদের কাছে খুব প্রিয়, কারণ এটি ভারতের আদর্শকে বাঁচাতে চায়।’
গত বছর বড়দিনের একদিন আগে রোমি থমাস নামের এক খ্রিস্টান যাজক ভারত জড়ো যাত্রায় অংশ নেন। সেসময় তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আজ বড়দিনের আগের দিন। এই পবিত্র দিনে আমরা রাহুল গান্ধী এবং তার ভারত জোড়ো যাত্রায় সমর্থন জানাচ্ছি। দেশের সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা মনে করি, কংগ্রেসই একমাত্র দল যারা এই ঘৃণার মোকাবিলা করে।’
২৩ বছর বয়সী বিএসসি শিক্ষার্থী শাজিয়া মমতাজের আশা, এই পদযাত্রা ঘৃণাকে পরাজিত করবে। তিনি বলেন, ‘ভারতের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। এই যাত্রা সেই ঘৃণাকে মোকাবিলা করতে পারে।’ বিহারের বাসিন্দা ৭৭ বছর বয়সী ডিবি সিং বলেন, ‘আমি কংগ্রেসের সমর্থক নই। তবে রাহুল গান্ধী অন্তত সেই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের উদ্বিগ্ন করে।’
এদিকে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি এখনও ভারতের শক্তিশালী দল। ভারত জোড়ো যাত্রা বিজেপিবিরোধী পালে সেভাবে হাওয়া দেয়নি-এটা ঠিক। তবে রাহুল নিজেও বলেছেন, তিনি জনগণের কথা শুনতেই হাঁটছেন।
ভারত জোড়ো যাত্রা শুরুর আগে ভারতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে রাহুল গান্ধী সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে চিঠি পাঠান তার ভারত জোড়ো যাত্রায় যোগ দেয়ার জন্য। তবে এখন পর্যন্ত বলতে গেলে কেউই তার সঙ্গে যোগ দেয়নি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা রাজনীতি করেন তারা রাহুলের সঙ্গে হাঁটেননি। তবে যাদের জন্য রাজনীতি, তারা রাহুলের সঙ্গে হেঁটেছেন। এ ছাড়া কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেসহ দলটির সব নেতাকে ছাড়িয়ে রাহুল যে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পেরেছেন, সেটিও একবাক্যে মেনে নিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাহুল দলে নিজের একটা ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। ভেঙে দিতে পেরেছেন বিজেপির তৈরি ‘পাপ্পু’ ইমেজ।
রাহুল নিজেও হয়তো বুঝতে পেরেছেন, তিনি আর বিরোধীদের আখ্যা দেয়া সেই পাপ্পু নন। এ কারণে ভারতের হরিয়ানায় সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, পাপ্পু নাম নিয়ে তিনি আর চিন্তিত নন। যে রাহুল গান্ধীর ছবি প্রত্যেকের মস্তিষ্কে রয়েছে, তিনি তাকে মেরে ফেলেছেন।
২০১৯ সালে ভারতের নির্বাচনে বড় জয় পায় নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। অন্যদিকে বিরোধীদল কংগ্রেস এবং তার নেতা রাহুল গান্ধী তখন পরাজিত, বিধ্বস্ত। এমনকি উত্তর প্রদেশের আমেথিতেও রাহুল গান্ধী হেরে যান। কংগ্রেসের এমন ফলাফলের পর রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তীতে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে সভাপতির পদ ছাড়েন রাহুল গান্ধী। দলটিতে তৈরি হয় ২৩ জন সিনিয়র নেতার গ্রুপ, যাদের বলা হতো জি-২৩। তারা সভাপতি পদসহ বিপুল সংস্কার চেয়েছিলেন।
২০১৯ সালে দলের সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধীর পদত্যাগের পর তার মা সোনিয়া গান্ধী অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। পরে রাহুল গান্ধীকে সভাপতির দায়িত্ব নিতে বলা হলেও তিনি আর দায়িত্ব নেননি। এর মধ্যেই বিরোধী বিজেপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাহুলকে ডাকতে শুরু করেন ‘পাপ্পু’। তাদের ভাষায়, রাহুল রাজনীতিতে পরিপক্ব নন। সাধারণ জনগণও যেন মেনে নিয়েছিল সেই ব্যাঙ্গত্মক মন্তব্য। তবে ভারত জোড়ো যাত্রা বিজেপির ব্যাঙ্গত্মক মন্তব্যে কুঠারাঘাত করেছে।
এখন ভারতের সাধারণ জনগণ থেকে বুদ্ধিজীবী সবাই রাহুল গান্ধীকে পরিণত রাজনীতিবিদ হিসেবেই দেখছেন। আর তা স্পষ্ট হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজনের কথায়। তিনি বলেছেন, ‘আমার মতে, রাহুলকে যে পাপ্পু বলা হয় সেটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রায় এক দশক ধরে বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি। এবার ভারত জোড়ো যাত্রাতেও ছিলাম। রাহুল কোনোদিক থেকেই পাপ্পু নন। তিনি একজন স্মার্ট তরুণ, কৌতূহলী ব্যক্তি।’ 


ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্য দিয়ে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন হয়তো আসবে না, তবে বিজেপি এবং তার শরিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে রাহুল গান্ধীকে যে আর ‘পাপ্পু’ বলে ডাকার ‘সাহস’ দেখাবেন না; সেটি মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

 

 

এনএমএম/

আর্কাইভ