• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

সোনায় মোড়ানো সীমান্তের রুট

প্রকাশিত: নভেম্বর ৩০, ২০২২, ০৫:৪৪ এএম

সোনায় মোড়ানো সীমান্তের রুট

আদালত প্রতিবেদক

১৭ নভেম্বর রাত ৮টা। খুলনা-২১ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে বিপুল পরিমাণ সোনার একটি চালান শার্শার পাঁচ ভূলাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হবে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে।  অভিযানকালে সাড়ে ৯ কেজি ওজনের ৮২ টি স্বর্ণের বার জব্দ করে।  

২১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তানভীর রহমান জানান, অভিযানের সময় সন্দেহভাজন এক মোটরসাইকেল আরোহীকে গতিরোধ করে জন্য থামতে বলা হয়। এ সময় সে  স্পিড বাড়িয়ে সোনা নিয়ে পালাতে গেলে মোটরসাইকেল নিয়ে পড়ে যায়। পরে মোটরসাইকেলে থাকা একটি কাপড়ের ব্যাগ থেকে ৯ কেজি ৫৫৮ গ্রাম ওজনের ৮২টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে আমরা গ্রেফতার করি। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে তার নাম মেহেদী বলে জানায়। 

একই সময়ে শার্শা ও বেনাপোল সীমান্তে আরও দুটি বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৪৯ ও ২১ বিজিবির সদস্যরা ২৬ কেজি ওজনের ১৯৪ পিস সোনার বার উদ্ধার করেছে। যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকা।  

এর তিন দিন পর ২০ নভেম্বর যশোরের চৌগাছার কাশিপুর-শাহজাদপুর সীমান্তের মরিচের ক্ষেতে মাটির নিচে লুকায়িত অবস্থায় প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা মূল্যের ৯ কেজি ২৮০ গ্রাম ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বার জব্দ করে বিজিবি। এর একদিন পরই শার্শার পাঁচ ভূলাট সীমান্ত থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের ৯ কেজি ৫৫৮ গ্রাম কেজি ওজনের ৮২টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়।  

গত ২৫ নভেম্বর বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে দর্শনাগামী পূর্বাশা পরিবহন ও রয়েল পরিবহনদুটি এসি বাসযোগে ও যাত্রীদের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাচালান হতে পারে।  এমন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযানে ৬৩৭ ভরি স্বর্ণ  জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২৯ নভেম্বর ঝিনাইদহের মহেশখালীর সীমান্তে ১১ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে বিজিবি। চলতি নভেম্বর মাসে বিজিবির অভিযানে সীমান্ত এলাকাগুলোতে বড় স্বর্ণের চালান জব্দের ঘটনা। এ ছাড়াও গত অক্টোবর মাসে মোট ২৭ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। আর সেপ্টেম্বর মাসে ৩১ কেজি ৮৫১ গ্রাম স্বর্ণ।  

শুধু যে যশোর সীমান্তের স্বর্ণ জব্দ হচ্ছে তা নয়, দেশের সীমান্তবর্তী অন্তত ১০ জেলার অর্ধশতাধিক চোরাচালান রুট যেন সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে। এসব স্থানের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে স্বর্ণ। গত তিন মাসে মাসে রুটগুলো থেকে ৭৫ কোটি টাকার স্বর্ণ উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পাশপাশি গ্রেফতার করা হয়েছে বাহকদের। গ্রেফতার ব্যক্তিদের দাবি, স্বর্ণগুলো বিভিন্ন বিমানবন্দর হয়ে দেশে আসে। এরপর ভারতে পাচারের উদ্দেশে নেয়া হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বর্ণ পাচারের সীমান্তঘেঁষা রুটগুলোর মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে তিনটি। এগুলো হলো-কার্পাসডাঙ্গা, দর্শনা ও জীবননগর। সাতক্ষীরা লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ৬টি-ভাদিয়ালী, কালীগঞ্জ, শেরপুর, ভোমরা, নোংলা ও কৈখালী। ঝিনাইদহের মহেশপুর, যশোরের পাঁচটি পয়েন্ট দিয়ে স্বর্ণ পাচার করা হয়। এ ছাড়া রাজশাহীর সোনাইকান্দি, হরিপুর, কাশিডাঙ্গা, আলাইপুর, বাগা, মুক্তারপুর ও চড়ঘাট; চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ, ভোলাহাট ও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ী, হিলি, কামালপুর ও বিরল; কুড়িগ্রামের রৌমারী ও ফুলবাড়ী এবং লালমনিরহাটের বুড়িরহাট, শ্রীরামপুর ও দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে স্বর্ণ পাচার হয়। এ ছাড়াও কুষ্টিয়ার সীমান্ত দিয়েও মাঝে মাঝে সোনা পাচার হয়।  

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সীমান্ত এলাকা দিয়ে স্বর্ণ পাচারে কৃষক, দিনমজুর, ট্রাক-লরির চালক, খালাসি, রাখাল ও জেলেদের ব্যবহার করা হচ্ছে। টিফিন বক্স, মৌসুমি ফলের ঝুড়ি, সবজি ও শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে রেখে স্বর্ণ পাচার করা হচ্ছে। স্বর্ণ চোরাকারবারিরা পাচারের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মোবাইল সিম ব্যবহার করে। কথাবার্তা চলে এসএমএসের মাধ্যমে। আকাশপথে স্বর্ণ আসার পর বাস ও ট্রেনে সীমান্তের জেলাগুলোতে পৌঁছে যায়।  

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ ও ভারতের বাজারে সরবরাহ করছে। এ কাজে তারা নিজস্ব বাহক যেমন ব্যবহার করছে, তেমনি টাকার টোপে কখনো পাইলট, কখনো ক্রু, কখনো বিমানবালাকেও কাজে লাগাচ্ছে।  

তাছাড়া বিমানের ক্লিনার, ট্রলিম্যান এমনকি প্রকৌশলীরাও এই চক্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে স্বর্ণ পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। যাত্রীবেশি বাহকের সঙ্গে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মোটর, দেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির ওপরের হ্যান্ডেল ও মানিব্যাগে করে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রোগী সেজে হুইল চেয়ারে, ঊরুতে অ্যাংকলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমরবন্ধনীর ভেতরে, শার্টের কলারের ভেতরে, স্যান্ডেলের সঙ্গে, সাবান কেসে, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপটরে, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কৌটা, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতর, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতর, মানিব্যাগে ও গলায় চেইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে লকেট হিসেবেও আনা হচ্ছে সোনার বার। এরপর নানা কৌশলে হাত বদল হয়।  

এ বিষয়ে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম বলেন, আমরা কেবল পাচারের সময় স্বর্ণ আটক করি। পাশাপাশি পাচারকারীদের গ্রেফতার করি। আমরা মামলার তদন্ত করি না। প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য পাই তা সঙ্গে সঙ্গেই প্রেস রিলিজ দিয়ে জানিয়ে দিই। এরপর আর বেশিকিছু জানার সুযোগ থাকে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা স্বর্ণ পাচারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি করছে। যেসব পয়েন্ট দিয়ে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে সেখানে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।  

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক পলাশ বলেন, বিমানবন্দরে স্বর্ণসহ সব ধরনের চোরাচালান রুখতে সবাই তৎপর।  তারপরও চোরাকারবারীরা নানা কৌশল করে স্বর্ণ চোরাচালান করে থাকে।

তিনি বলেন, বর্তমানে বৈধভাবে প্রবাসীরা স্বর্ণ নিয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে চোরাকারবারীরা কিছু টাকার বিনিময়ে ২টি বার ১০০ গ্রাম অর্ণামেন্ট লিগ্যাল ভাবেই আনার জন্য একজন প্রবাসীকে ভাড়া করলেন।  এভাবে ১০ জন ভাড়া করলে ২০টি স্বর্নের বার ১ কেজি অর্ণামেন্ট আনা হলো। এরপর ওই ১০ জন যখন চোরাকারবারীর নিকট দিয়ে দিচ্ছে তখন সেটি অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। আর এগুলো একত্রিত করে চোরাকারবারীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করছে।  

তিনি আরও বলেন, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা বিমানবন্দরে সবধরনের চোরাচালান রোধে কাজ করে যাচ্ছে। 

আইএ/এএল

 

 

আর্কাইভ