• ঢাকা শুক্রবার
    ০৪ অক্টোবর, ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

ঋণ খেলাপিদের ধরার পদক্ষেপের কোনো কথা বলা হয়নি প্রস্তাবিত বাজেট

প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২৪, ১০:৩৫ এএম

ঋণ খেলাপিদের ধরার পদক্ষেপের কোনো কথা বলা হয়নি প্রস্তাবিত বাজেট

সিটি নিউজ ডেস্ক

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার আগে বলেছিলেন, ‘ঋণ খেলাপিদের ধরতে চাই। এবার ধরব।’ কিন্তু   খেলাপিদের ধরার পদক্ষেপের কোনো কথা বলা হয়নি প্রস্তাবিত বাজেটে। ঋণখেলাপি শব্দটিও  কোথাও উল্লেখ নেই বাজেট বক্তৃতায়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। যদিও প্রকৃত তথ্য আরও অনেক বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। আলোচ্য ১৫ বছর তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার ৮১৪ টাকা। বৃদ্ধির হার ৭১১ শতাংশ বা ৮ গুণের বেশি।

এর আগে ১৯৯০ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল ১৮ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৮৪ শতাংশ বা প্রায় ৫ গুণ।

আগের ১৮ বছরের চেয়ে বর্তমান সরকারের ১৫ বছরে অর্থনীতির আকার বেড়েছে, ব্যাংকের সংখ্যার পাশাপাশি বেড়েছে শাখা। ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে ব্যাংকে আমানত যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ঋণ। এসব বৃদ্ধির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর তদারকি বাড়েনি।

সরকার থেকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে বা নীতিসহায়তা দিয়ে ঋণখেলাপিদের পক্ষে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ কারণে বেড়েছে জালিয়াতি। এর মাধ্যমে নেওয়া ঋণের প্রায় পুরো অংশই একটি পর্যায়ে খেলাপি হচ্ছে। ফলে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ে এরশাদ সরকারের আমল থেকেই দেশের অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন। কিন্তু কোনো সরকারই এগুলো তেমন একটা আমলে নেয়নি। ২০১২ সালের পর ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠনের দাবি ওঠে। প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা করা হয়নি।

২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় সরকার আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ নিলে সংস্থাটি অনেক শর্ত আরোপ করে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়টিও রয়েছে। আইএমএফের সূত্র ধরে ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনার চিত্রটি আবার সামনে চলে আসে। সরকারও বাধ্য হয়ে অঙ্গীকার করে ব্যাংক খাত সংস্কারের। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত সংস্কারের বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কোনো সুফল দৃশ্যমান নয়। এমনকি ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হবে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার, ব্যাংক একীভূত করার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোতে আরও বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সংস্থাটি ঘনঘন নীতির বদল করছে। এতে ব্যাংক খাতে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হিসাব দিচ্ছে তা হচ্ছে সংজ্ঞার ভেতরে থেকে ব্যাংক যেসব ঋণ খেলাপি করে তার হিসাব। এর বাইরে অবলোপন করা হয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপ অর্থাৎ বিশেষ হিসাবে রয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা, যেগুলো খেলাপি হচ্ছে। প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। যেগুলো খেলাপি হচ্ছে। এছাড়া খেলাপি হওয়ার যোগ্য কিন্তু ব্যাংকগুলো খেলাপি করছে না। এছাড়া আদালতের নির্দেশনায় ৬০ হাজার বেশি ঋণকে খেলাপি হিসাবে দেখানো যাচ্ছে না। এসব মিলে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ।

ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে ঋণ বিতরণ করেছে। ওইসব ঋণ থেকে যে আয় হয় তা থেকে আমানতের মুনাফা দেওয়া হয়। গ্রাহকের আমানতের যে পাঁচ লাখ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, এর বিপরীতে কোনো আয় হচ্ছে না। উলটো খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে খরচ হচ্ছে। কিন্তু আমানতকারীদের মুনাফা দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোকে কোনো আয় না করেই মুনাফা দিতে হচ্ছে অন্য খাতের আয় থেকে। এতে ব্যাংকের সার্বিক আয় কমে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় মামলা পরিচালনা ও জামানত দেখভাল এসব খাতেও ব্যাংকগুলোর মোটা অংকের টাকা খরচ হচ্ছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৮২ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে প্রভিশন খাতে। এভাবে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের আয় কম ও খরচ বেশি হচ্ছে। এছাড়া প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির কারণে ব্যাংক দুর্বল হচ্ছে।

গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের পর প্রথমেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে ঋণখেলাপি হতে তিন মাস সময় লাগে। যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থি। খেলাপি ঋণের প্রচলিত সংজ্ঞার বিষয়ে আইএমএফ আপত্তি করলে তা আংশিক সংশোধন করা হয়। বাকিটা পরে করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।

এরপর করোনা শুরু হলে সব ধরনের ঋণগ্রহীতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয়। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলার জন্যও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়। এসব সুবিধায় ২০২২ সালে ৬৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। যা এখন আবার খেলাপি হচ্ছে। এ সময় কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমান গভর্নর নিয়োগ পান ২০২২ সালের জুলাই মাসে। এসেই তিনি ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দিয়ে নতুন একটি নীতিমালা জারি করেন। নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।

নতুন নীতিমালায় খেলাপি ঋণের সুবিধা প্রদান ও পুনঃতফশিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালকরাই ঠিক করছেন কোন ঋণ পুনঃতফশিল সুবিধা পাবে। আগে ঋণ পুনঃতফশিলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। এর ফলে খেলাপি ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরও বেড়েছে।

আর্কাইভ