• ঢাকা শনিবার
    ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

১০০ বছরে যে গ্রামে যায়নি পুলিশ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২২, ০৭:২৪ পিএম

১০০ বছরে যে গ্রামে যায়নি পুলিশ

নাটোর প্রতিনিধি

গ্রামের নাম হুলহুলিয়া। নাটোর সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত। নাটোর সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া উপজেলা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে এই হুলহুলিয়া গ্রাম। সবার কাছে আদর্শ গ্রাম নামেই পরিচিত।

এই গ্রামে গত ১০০ বছরে কোনো মামলা-মোকদ্দমার জন্য পুলিশকে যেতে হয়নি। যে গ্রামে রয়েছে তাদের নিজস্ব নিয়মনীতি বিচারব্যস্থা। হুলহুলিয়া গ্রামটি ১২টি পাড়া নিয়ে গঠিত। গ্রামের আয়তন প্রায় বর্গকিলোমিটার। গ্রামে মানুষ সবাই শতভাগ শিক্ষিত। শিক্ষার স্যানিটেশন-ব্যবস্থার হার প্রায় শতভাগ। গ্রামটি বাল্যবিবাহ, মাদক যৌতুকমুক্ত। এ জন্যই  গ্রামটিকে সরকার আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এই আদর্শ গ্রামে প্রবেশ করতে গেলেই প্রথমেই চোখে পড়ে গ্রামের প্রবেশমুখে বিশাল একটি গেট। যেখানে লেখা রয়েছে 'আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া' ২০১০ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গেটটি স্থাপন করে দেন। গ্রামটি পরিচালনা করার জন্য নিজস্ব সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান একজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ মোট ২১ জন সদস্য এবং পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও রয়েছে। যারা সবাই গ্রামের পুরুষ ভোটারদের দ্বারা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। দুই বছর পর পর ভোটের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করেন গ্রামবাসী। গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, একটি মাদরাসা একটি মসজিদ রয়েছে। গ্রামটিতে দুই শতাধিক বিএসসি প্রকৌশলী, শতাধিক এমবিবিএস ডাক্তার, ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১১ জন বিচারকসহ নানা পেশার মানুষ রয়েছেন।

বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মরহুম মোহাম্মদ হানিফ উদ্দিন মিয়া এই গ্রামের বাসিন্দা। সম্প্রতি ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার তার স্মরণে ডাক অধিদফতরের স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন। এ ছাড়া তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল হাব স্থাপন করা হয়েছে। মোস্তাফা জব্বার নিজে গিয়ে সেই ডিজিটাল হাবের উদ্বোধন করেন। এ ছাড়া গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে আইন বিভাগের সাবেক সচিব মরহুম এ কে কাদের তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মির্জা মনজুরুল কাদের জুয়েল, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এম এম রহমতুল্লাহ   নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ার জমসেদ আলী রয়েছেন। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ইউনিটের চেয়ারম্যান ডা. মাহবুবুর রহমান, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডিন . মন্টু তালুকদার কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের পরিচালক . জিল্লুর রহমান এই গ্রামের বাসিন্দা।

২০১৬ সালে কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠিত করা হয়। হাব তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এর উদ্বোধন করেন। এই ডিজিটাল হাব সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে ১১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর, একটি লাইভ টেলিভিশন রয়েছে। এ ছাড়া একটি ডিজিটাল ইসিজি রুমও রয়েছে। হুলহুলিয়া গ্রামের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে।

এই গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গ্রামে এসএসসি পাস করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাসের আগে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে পারবে না। কেউ কোনো কারণে তার মেয়েকে ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে দিতে চাইলে, কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে তা জেনে সমাধান করা হয়। বিয়ের সময় যৌতুক নেয়া-দেয়াও এখানে সম্পূর্ণ নিষেধ।’

আরেক বাসিন্দা রহিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের গ্রামে কোনো মামলা নেই। কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে সমাধান করা হয়।’

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোআল তৌফিক পরশ বলেন, ‘আমাদের গ্রামে যদি কোনো ঝগড়া-বিবাদ লাগে তা আমাদের নিজস্ব বিধিবিধান দিয়ে মীমাংসা করা হয়। এ জন্য কোনো বিষয় নিয়ে থানা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমাদের গ্রামের মানুষ শতভাগ শিক্ষিত। এখানে কোনো বাল্যবিবাহ হয় না। সবাই সচেতন।’

নাটোর সিংড়া থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিক জানান, আমি প্রায় দুই বছর ধরে থানায় চাকরি করছি। সময়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা করতে দেখা যায়নি। হুলহুলিয়া গ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো।

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম এম সামিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি, বাংলাদেশের মধ্যে এই হুলহুলিয়া একটি আদর্শ গ্রাম। গ্রামে নিজস্ব বিচার ব্যস্থা রয়েছে। কোনো ধরনের ঘটনা হলে তারা নিজেরাই বিচার সালিসের মাধ্যমে তা সমাধান করেন।’

জেডখান/এম. জামান

আর্কাইভ