প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২১, ০৬:৪৮ পিএম
বলিউডের ষড়যন্ত্রে হারিয়েই গেলেন বাংলার সঙ্গীত দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় গায়িকা আরতি মুখোপাধ্যায়। নেপথ্যে রয়েছে পক্ষপাতিত্ব ও ষড়যন্ত্র।
বলিউডের স্বর্ণযুগের শিল্পীদের মধ্যে গণ্য করা হতো তাকে। সঙ্গীত পরিবারেই জন্ম হয়েছিল
আরতির। তার বাবা-মা দুইজনেই খুব ভালো গাইতেন। ছোটবেলায় মায়ের কাছে গান শিখতেন তিনি।
খুব অল্প বয়সেই আরতির বাবা
মারা যান। ছোটবেলায় পূজার সময় নতুন জামা কেনার বদলে দিদিমার থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে
মূল্যবান তানপুরা নিয়েছিলেন তিনি। তার গানের শিক্ষক ছিলেন সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার কাছেই গান শিখতে শুরু করেন আরতি। প্রথমবার অংশগ্রহণ করেছিলেন চেতলার আদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতা ‘মুরারি সঙ্গীত সম্মেলন’-এ। সেখানে বিজয়ী হয়েছিলেন
আরতি। সেই থেকেই সঙ্গীত জগতে তার কেরিয়ার শুরু।
এই প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন
প্রখ্যাত শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের নজরে পড়ে গিয়ে প্রথমবার
প্লেব্যাকের সুযোগ পান আরতি। সে সময় রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘মামলার ফল’ ছবিতে
গান যে প্লেব্যাক শুরু। এরপর একে একে সুচিত্রা সেন, তনুজা, অপর্ণা সেন, সুপ্রিয়া দেবীর
মতো নায়িকার হয়ে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। ‘গল্প হলেও সত্যি’ এবং
‘ছুটির ফাঁদে’ ছবিতে
গান গেয়ে পরপর দুইবার বিএফজে পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন বাংলার এই গায়িকা। বাংলা ছবির
পরবর্তী যুগে দেবশ্রী, শতাব্দীর মতো আধুনিক নায়িকাদের লিপে গান গেয়েছেন আরতি।
আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে
তখন ‘তোমার একুশ বছর বোধহয়’ গানটি তো আজও শ্রোতাদের ভীষণ
প্রিয়। উল্লেখ্য, এই গানের গীতিকার সুবীর হাজরা গায়িকার প্রথম স্বামী ছিলেন। তাদের
জুটি সঙ্গীত দুনিয়াকে বহু সুপার হিট গান উপহার দিয়েছে। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তাদের সম্পর্ক
তলানিতে পৌঁছেছিল। আরতির স্বামী তাকে পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন। তিনি কোন গানের
প্রস্তাব নেবেন, অনুষ্ঠানে কোন শাড়ি পরবেন সেটাও নাকি স্বামীই ঠিক করে দিতেন।
অবশেষে অসুখী দাম্পত্য থেকে
বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন আরতি। পাড়ি দেন বোম্বে। পাঁচ বছর ছেলে সোহমকে নিয়ে সিঙ্গেল
জীবনযাপনের পর মায়ের অনুরোধে শেষমেষ গুজরাটি মুনিম পরিবারে বিয়েতে সম্মতি দেন আরতি।
তবে এই বিয়ের শর্ত ছিল, ছেলে সোহমকে পন্ডিচেরী অরবিন্দ আশ্রমে রেখে মানুষ করতে হবে।
আরতি তাই মেনে নিয়েছিলেন। এক দিকে সংসার অপর দিকে কেরিয়ার, দুইয়ের চাপে পিষ্ট হতে
হতো গায়িকাকে। তার উপর আবার পেশাগত জীবনে হিংসা, রেষারেষি, ষড়যন্ত্র কিছু কম ছিল না।
আরতির প্রতি হিংসা এমন পর্যায়ে
পৌঁছে ছিল যে এক সময় তার খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন
আরতি। সে সময় আসলে বলিউডে লতা, আশাদের রাজত্ব করেছিল। সেখানে আরতির উত্থান ভালোভাবে
নেননি অনেকেই। ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবিতে শ্যামল মিত্রের সঙ্গে
‘কথা
কিছু কিছু বুঝে নিতে হয়’ গানটি গেয়েছিলেন আরতি। তবে
ছবিটি যখন বলিউডের মুক্তি পায় তখন সেই গান বদলে যায় শ্যামল মিত্র এবং প্রীতি সাগরের
জুটির নামে।
শুধু তাই নয়, এমন অনেক গান
আছে যেখানে প্রথমে তাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর কথা থাকলেও পরে তাকে সরিয়ে লতা মঙ্গেশকারকে
সুযোগ করে দেওয়া হয়। আশা ভোঁসলের কারণে আর ডি বর্মনের সঙ্গে তার চুক্তি ভেঙেছে। এমনকি
উপর মহলের চাপে বাপ্পি লাহিড়ীও আরতিকে দিয়ে গান গাওয়াতে পারেননি। গানের জগতে এভাবেই
ক্রমাগত তাকে কোণঠাসা করে তোলা হয়েছিল।
শেষমেষ গানের জগৎ থেকে সরে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কিংবদন্তি গায়িকা আরতী মুখোপাধ্যায়। বর্তমানে মুম্বাইয়ের
একটি ফ্ল্যাটে তিনি তার ছেলে সোহমের সঙ্গেই থাকেন। তার ছেলে একজন জনপ্রিয় সেতার, বাঁশি
এবং পিয়ানো বাদক। গ্লামার দুনিয়া থেকে দূরে নিজের আলাদা এক সংগীতমহল প্রতিষ্ঠা করে
আরতি মুখোপাধ্যায় আজও একান্তে গান গেয়ে চলেছেন। সেখানে নেই কোনো ষড়যন্ত্র, নেই রেষারেষি।
এস/এএমকে/এম. জামান