• ঢাকা মঙ্গলবার
    ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যায়ন প্রতিবেদন

যেসব কারণে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে ব্যাংক খাতে

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৪, ১১:৪৯ পিএম

যেসব কারণে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে ব্যাংক খাতে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে ব্যাংক খাতে। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ, সুদহার, বিনিময় হারজনিত ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোর সার্বিক মূলধনও কমেছে। ঋণের স্থিতি বাড়ায় ব্যাংকগুলোর সম্পদ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।  মোট খেলাপি ঋণের ৪৫ শতাংশের বেশি রয়েছে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের কাছে।

সোমবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। প্রতি তিন মাস পরপর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

গত বছরের জুন-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে সোমবার। প্রায় সাত মাস পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। আগে এ প্রতিবেদন ২ থেকে তিন মাস পরই প্রকাশ করা হতো। ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির প্রবণতা বাড়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব প্রতিবেদন দেরিতে প্রকাশ করছে।

এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সূচক ব্যবহার করে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি নিরূপণ করে। কোন সূচকে কী পরিমাণ ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত হলে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিতে পড়বে তা নিরূপণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে আগাম সতর্ক করে। 

গত জুনে ৪টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল। সেপ্টেম্বরে বেড়েছে ৫টি ব্যাংকের। ব্যাংকের শীর্ষ তিন ঋণ গ্রহীতা  খেলাপি হলে গত জুনে ২০টি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়ত। সেপ্টেম্বরে তা একটি কমে ১৯টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ কিছু ব্যাংকের তিনজন শীর্ষ ঋণ গ্রহীতা খেলাপি হলে ১৯টি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়বে।

ব্যাংক খাতে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। গত জুনে সুদের হারজনিত কারণে ১টি ব্যাংক ঝুঁকিতে ছিল। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ২টিতে দাঁড়িয়েছে। সংকটের কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারও বেড়ে যাচ্ছে। গত জুনে বিনিময় হারে কোনো ব্যাংক ঝুঁকিতে ছিল না। সেপ্টেম্বরে একটি ব্যাংক বিনিময় হারজনিত কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে। গত জুনে মূলধনজনিত কারণে কোনো ব্যাংক ঝুকিতে ছিল না। সেপ্টেম্বরে এসে শুধু মূলধনের কারণে ২টি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।  

ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকি জুনে ছিল ৮৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ১৫ শতাংশে। একই কারণে গত জুনে বাজার ঝুঁকি ছিল ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮১ শতাংশে। তবে পরিচালনগত ঝুঁকির মাত্রা কিছুটা কমেছে। খেলাপি ঋণ ও বিভিন্ন খাতে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ায় ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সে অনুপাতে ব্যাংকগুলো মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর সার্বিক মূলধন গত জুনে ছিল ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ও সম্পদ এখনো কেন্দ্রীভূত অবস্থায় রয়েছে। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের কাছে খেলাপি ঋণ ৪৫ শতাংশ। বাকি ৬৫ শতাংশ অন্য ব্যাংকগুলোতে। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে রয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৬৩ শতাংশ। বাকি ৩৭ শতাংশ রয়েছে অন্য ব্যাংকগুলোতে। অর্থাৎ কয়েকটি ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বেশি। এদের কারণে পুরো ব্যাংক খাত আক্রান্ত হচ্ছে।

ব্যাংকগুলোর সম্পদের বড় অংশই হচ্ছে ঋণ। এর বাইরে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। মোট সম্পদের ৩১ শতাংশ রয়েছে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের কাছে। বাকি ৬৯ শতাংশ রয়েছে অন্য ব্যাংকগুলোর কাছে। ১০ ব্যাংকের কাছে রয়েছে ৪৫ শতাংশ। বাকি ৬৫ শতাংশ অন্য ব্যাংকগুলোর কাছে। ব্যাংকগুলোর সম্পদের মধ্যে স্থায়ী সম্পদ কমে গেছে। গত জুনে স্থায়ী সম্পদ ছিল ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। এখন তা কমে ১ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্ধারিত হারে টাকা জমা রাখতে হয়। যেসব জেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা নেই, ওইসব জেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে কাজ করে সোনালী ব্যাংক। ফলে সোনালী ব্যাংকেও সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোকে টাকা জমা রাখতে হয়। জরুরি প্রয়োজনে এ অর্থ তুলে নিয়ে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদা মেটাতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জমা কমে গেছে। গত জুনে ছিল ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জমা কমেছে।

এদিকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের খরচ বেড়ে গেছে। গত জুনে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে ব্যাংকগুলোর খরচ হতো ১৬ টাকা ৪৩ পয়সা। অর্থাৎ ১৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোকে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে খরচ হচ্ছে ১৬ টাকা ৬৭ পয়সা।

গত জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমেছে। গত জুনে ব্যাংকগুলো মোট আমানতের ৭৮ দশমিক ৫১ শতাংশ বিনিয়োগ করেছিল। সেপ্টেম্বরে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে পারত। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে পারেনি। কারণ ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বেড়েছে। এছাড়া ঋণ আদায় কম  হওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ অর্থের প্রবাহ কমেছে। মূলধন সংরক্ষণে বেশিরভাগ ব্যাংককেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাড়তি ছাড় দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের প্রান্তিকগুলোর মতো গত জুন-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হারের ঊর্ধ্বগতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।  

অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ