মুনওয়ার আলম নির্ঝর
                                  
              একটা সময় এ দেশে নৌদুর্ঘটনা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সময় যত গড়িয়েছে বড় বড় লঞ্চগুলো দুর্ঘটনায় পড়া বন্ধ হয়েছে। তবে ছোট ছোট লঞ্চ ডোবা একেবারে বন্ধ হয়নি। সেদিক থেকে আমাদের দেশে নৌখাতের পরিচিত দুর্ঘটনা ছিল- দুই লঞ্চের সংঘর্ষ কিংবা ডুবে যাওয়া। এই ধরনের দুর্ঘটনায় দেশে গত ৫০ বছরে ২০ হাজারের বেশি মানুষ জীবন দিয়েছে। 
তবে আজ ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এক নতুন ধরনের নৌদুর্ঘটনা দেখল। পানির ওপরে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে গোটা একটা জাহাজ। শুধু জাহাজ না, সেই জাহাজের ভেতরেই পুড়ে মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। আহত কিংবা অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন শতাধিক যাত্রী। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা ঘটার আগ পর্যন্ত লঞ্চে আগুন প্রতিরোধের বিষয়টাকে গুরুত্ব দিত না। এখন অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পরেই সবাই গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ ধরনের দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির পরামর্শগুলো ঠিকভাবে মেনে চলা খুবই জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক ইমরান উদ্দিন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কেন যেন শেষ পর্যন্ত আর সব পরামর্শগুলো ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেন না বলে মন্তব্য করেন বুয়েটের এই শিক্ষক। 
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই প্রভাষক সিটি নিউজকে বলেন, ‘আমাদের যদি টার্গেটটা এমনই থাকে যে, তদন্তের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হবে মাস্টার, চালক, ড্রাইভার ও সুকানি। তাদের কিছু জেল-জরিমানা দিয়ে একটা সমাধান- এটা সম্পূর্ণ ভুল। এভাবেই চালিয়ে যেতে থাকি তাহলে কখনই আমাদের দুর্ঘটনা কমবে না বরং সামনে আরও নতুন নতুন ধরনের দুর্ঘটনা হবে। কাজেই সাজা দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করা যাবে না। কাজেই আমাদের গোড়ায় হাত দিতে হবে।’ 
এদিকে দেশে যখনই কোনো জাহাজ বা লঞ্চ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তখন জানা যায়- সেই নৌযানটির ফিটনেস ঠিক ছিল না। থাকে আরও নানা অনিয়মের অভিযোগ। এমনকি বিআইডব্লিউটিএ'র দুর্নীতির কথাও বারবার উঠে এসেছে এসব দুর্ঘটনার পর। 
তবে এই শিক্ষক মনে করেন, সার্ভে এবং ফিটনেসের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।  ৪-৫ জন সার্ভেয়ার দিয়ে দেশের এতগুলো নৌযান সার্ভে করা সম্ভব না। কাজেই যে পরিমাণ সার্ভেয়ার দরকার হয় সেই পরিমাণ সার্ভেয়ার নিয়োগ দেয়া এখনই জরুরি। তারপর প্রত্যেকটা জাহাজ সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। 
এ ছাড়া চালক-মাস্টার-ড্রাইভার এদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ লাগবে। শুধু প্রমোশোনের সময় একটা সার্টিফিকেট দিয়ে দিলাম, এর মাধ্যমে তাদের দক্ষতা কখনই যাচাই হয় না। আমাদের দেশের নৌশ্রমিকরা ট্রেনিং দূরে থাক- নামই হয়তো জানেন না এই আগুন নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জামের। কাজেই নিয়মিত ট্রেনিং হলে তাদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। এই জন্য তাদের নিয়মিত ট্রেনিং করাতে হবে। 
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল সিটি নিউজের সঙ্গে আলাপকালে বিস্ময় প্রকাশ করেন! তিনি মনে করতে পারেন না এর আগে তিনি কখনও এমন নৌদুর্ঘটনা দেখেছেন কিনা। তবে লঞ্চের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘লঞ্চে প্রত্যেক জায়গাতেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা আছে। বিভিন্ন জায়গায় আছে। কিন্তু এই অ্যাক্সিডেন্টের সময় কেউই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র তো চালাতেই পারে নাই। কেউ সময়ই পায় নাই। তারা যেটা আমাকে বলেছে।’ 
নৌপুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (বরিশাল জোন) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বক্তব্যে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, অভিযান-১০ লঞ্চটি যখন নলছিটি ক্রস করে তখন এর ইঞ্জিনে আগুন লাগে। কিন্তু লঞ্চটি নলছিটিতে স্টপেজ দেয়নি, ঝালকাঠিতেও স্টপেজ দেয়নি। লঞ্চটি প্রায় ১ ঘণ্টা অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় চলতে থাকে।
পরবর্তীতে ইঞ্জিনের আগুন সম্ভবত তেলের ট্যাঙ্কিতে লাগে এবং বিকট শব্দে লঞ্চটি ঘটনাস্থলে এসে থেমে যায়। 
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ইঞ্জিনের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের গাফিলতির কারণেই যে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা আমরা এ মুহূর্তে নিশ্চিত। বিস্তারিত তদন্তের পর বলতে পারব।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদলও মনে করেন ড্রাইভার-মাস্টার, সুকানিদের শুধু  অগ্নিনির্বাপনের ওপর ট্রনিং থাকা দরকার। বাকিদের ট্রেনিং দেয়ার তিনি পক্ষে না। তিনি মনে করেন, যারা টেকনিক্যাল দায়িত্বে আছেন তারা চাইলে আগুন নিভিয়ে ফেলতে পারবেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, এত বড় একটা লঞ্চের আগুন মাত্র এই কয়েকজন মানুষ মিলে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে মনে হলেও বিশেষজ্ঞরা এটাকে পুরো অসম্ভব বলেই মনে করছেন। তাই একটি লঞ্চের সকলের প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে।  
তবে বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘মাস্টার এবং ড্রাইভার যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, সার্টিফিকেট পাচ্ছে এদের টেকনিক্যালি কোনো ট্রেনিং নেই। আমরা চাই, পরীক্ষা দেয়ার আগে তাদের ট্রেনিং করাতে। সার্টিফিকেট দেয়ার আগে এই ট্রেনিং (অগ্নিনির্বাপণ ট্রেনিং) করালে ভালো হয়।’ 
নৌদুর্ঘটনার বিশ্লেষকরা সব কিছুর পর একটা কথাই বারবার বলছেন। আর সেটা হলো- এখনই যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া যায় কিংবা 'গোড়ার গলদ' ঠিক করা না যায় তাহলে আগামী দিনগুলোতে এই ধরনের দুর্ঘটনা বিভিন্ন আঙ্গিকে ও বিভিন্ন আকারে প্রকাশ পাবে।
নির্ঝর/ডা
									
                                  
                                
                  
                    
                  
                    
                      ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন