• ঢাকা সোমবার
    ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুঃখভারাক্রান্ত নদীদের গল্প

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩, ০৩:৩৩ এএম

দুঃখভারাক্রান্ত নদীদের গল্প

দিন দিন দখল এবং শুকিয়ে যাচ্ছে নদী

ফিচার ডেস্ক

‘আমার একটা নদী ছিল, জানলো না তো কেউ/এই খানে এক নদী ছিল, জানলো না তো কেউ।’ শিল্পী পথিক নবীর মতোই এখন আমাদেরও বলতে হচ্ছে— আমাদেরও এক সময় অনেক নদী ছিল, যার অনেকগুলোই আজ হারিয়ে গেছে।

কবি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার কয়েকটি পংক্তি এমন— ‘আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি, চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে। তেরশত নদী সুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’ কবির কবিতায় উল্লিখিত তেরোশত না হলেও অসংখ্য নদী ছিল আমাদের, যা আজ অস্তিত্বহীন।.

আন্তর্জাতিক নদী মানে কী? পদ্মাকে কেন আন্তর্জাতিক নদী বলা হয়? - Quora

বাংলাদেশ নদীমাতৃক। হিমালয় থেকে নেমে আসা অসংখ্য নদ-নদীর প্রবাহ থেকে এই দেশটির সৃষ্টি হয়েছিল। পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার বছর ধরে বহমান সেই নদীর পলিমাটি থেকে। এই নদীকেই কেন্দ্র করেই মানুষ তার জীবন-জীবিকার পথ তৈরি করে নিয়েছে; তৈরি হয়েছে গান, কবিতা, উপন্যাস ও চলচ্চিত্র।

নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নদীর বয়ে আসা পলিমাটিতেই বাংলাদেশের কৃষিজমি অত্যন্ত উর্বর। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে নদীই ভরসা। সেচ আর বিদ্যুতের জন্যও নদীর দরকার।

তবে বাংলাদেশ এখন নদী বিপর্যয়ের দেশ। আড়াই শতাধিক নদ-নদী মরে যাওয়ার কথা জানা যায়। অনেক বেদখলও হয়ে গেছে। অস্তিত্ব, বিপন্ন হয়েছে। নাব্যতা, গভীরতা, আকার আকৃতি হারাচ্ছে দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ নদী। এ অবস্থায় নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদ-নদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর শঙ্কা।

‍‍`নদীমাতৃক‍‍` শব্দটি কি হারিয়ে যাবে

একদিকে সীমান্তের ওপারে বাঁধ তৈরি করে উজানে এক তরফা পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের নদীগুলোতে দেখা দিয়েছে জলসঙ্কট। অন্যদিকে, দেশের মধ্যেই অতিরিক্ত পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী। যার কারণে বহু নদীই এখন দেশের মানচিত্র থেকে হয়তো ইতোমধ্যেই হারিয়ে গিয়েছে, নয়তো কোনো রকমে ধুঁকছে।

বাংলাদেশে প্রকৃত নদীর সংখ্যা জানা যায় না। নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, দপ্তর এমনকি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট— কারও কাছেই সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ২০১৩ সালে গঠন করা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছেও নেই। বিভিন্ন সূত্রে নদীর যে সংখ্যা জানা যায়, সেই সংখ্যায় বিস্ময়কর রকমের পার্থক্য রয়েছে। ২৩০ থেকে দুই হাজার পর্যন্ত সংখ্যা পাওয়া যায়।

Karnaphuli shrinks due to encroachment‍‍` | Prothom Alo

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি) ২০০৫ সালে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। এতে ৩১০টি নদ-নদীর কথা বলা হয়েছিল। এরপর ২০১১ সালে আরও অনুসন্ধান শেষে গ্রন্থটি ছয় খণ্ডে প্রকাশ করে পাউবি। সেখানে নদ-নদীর সংখ্যা বলা হয় ৪০৫টি। অনেকেই এই সংখ্যাকে নদীর সংখ্যা হিসেবে গণনা করছেন।

পাউবোকর্তৃক নির্ধারিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১০২টি, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১১৫টি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৮৭টি, উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের ১৬টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ২৪টি হিসেবে বিভাজন করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই শত শত নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে।

৫৭ বছরে মরে গেছে ১৫৮ নদী | Patheo24

২০১০ সালে বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরাম এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত— এই ৫৭ বছরে দেশে শুকিয়ে গেছে ১৫৮টি নদী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একদল গবেষক মৃতপ্রায় নদীর তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাতে বলা হয়, দেশের ১১৫টি নদ-নদী শুকিয়ে গেছে।

অন্য দিকে নদী, পানি–প্রকৃতি নিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।

নদীর পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে এক দিকে যেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে পানি দূষিত হওয়ার কারণেও মরে যাচ্ছে নদী। অনেক নদ-নদীতে পানির প্রবাহ আছে ঠিকই, কিন্তু তা এমনভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে যে, নদীর পানি আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। এসব নদীর মধ্যে শীর্ষে আছে বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী।

Pagla River dying due to siltation | The Asian Age Online, Bangladesh

বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি নদী হলো— পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলি, শীতলক্ষ্যা, গোমতী। দীর্ঘতম নদী সুরমা। ৩৯৯ কিলোমিটার এর দৈর্ঘ্য। সব থেকে চওড়া নদী যমুনা। দীর্ঘতম নদ ব্রহ্মপুত্র। গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গা, এর থেকে পদ্মা হয়ে সাগরে মিশেছে। আবার ব্রক্ষপুত্র থেকে যমুনা হয়ে সাগরে মিশেছে। লুসাই পাহাড় থেকে মেঘনার উৎপত্তি। বাংলাদেশের সব নদীর উৎপত্তি হিমালয় থেকে। একমাত্র সাংগু নদীর শুরু ও শেষ বাংলাদেশে।

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু, লৌহজঙ্গ কিংবা শীতলক্ষ্যার মতো নদীগুলোর দু’ধারে যে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, তার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে পড়ছে এসব নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় মরে যাচ্ছে নদীর প্রাণ।

মরা নদীর প্রাণ ফেরানোর উদ্যাগ, চলছে সমীক্ষা

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিমাখা কপোতাক্ষ নদ। আজ এ নদী একটা মৃতপ্রায় খাল। ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত, নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। এসব নদীর এখন বেহাল দশা। অথচ পাঁচ দশক আগেও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি সরাসরি পান করা যেতো। আজ দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মাত্রাতিরিক্ত ক্লোরিন প্রয়োগ করেও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি শোধন করা যাচ্ছে না।

কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উঠে আসা ধানসিঁড়ি নদী এখন শুকিয়ে কাল হয়ে গেছে। বড়াল নদীকে দেখলে এখন বিশ্বাস করতে হবে যে এটি একটি নদী। চলন বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীর মাঝ বরাবর তৈরি করা হয়েছে একটি ক্রস-ড্যাম বা আড়ি-বাঁধ।

একই অবস্থা ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোনার মগড়া, কংশ ও সোমেশ্বরী, যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতী, বেতনা, মুক্তেশ্বরী; কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরী; খুলনার রূপসা, শিবসা, ডাকি, আত্রাইয়ের মতো নদীগুলো এখন মৃত্যুর দিন গুনছে।

থেমে নেই বুড়িগঙ্গার দূষণ। কালো দুর্গন্ধময় পানিতে ভাসছে ময়লা আবর্জনা।  গতকাল জিঞ্জিরা এলাকায় -ইকবাল হাসান নান্টু

ফরিদপুরের কুমার, বগুড়ার করতোয়া, কুমিল্লার গোমতী, পিরোজপুরের বলেশ্বর, রাজবাড়ীর গড়াই, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, বান্দরবানের সাঙ্গু, খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, নওগাঁর আত্রাই, জামালপুরের ঝিনাই নদীরও হয়েছে একই পরিণতি।

নদী কখনো মরে যায় না, খাত পরিবর্তন করে মাত্র। কিন্তু আমরা নদীর পানির উত্সমুখ বন্ধ করে, ভরাট করে, দখল করে নদীকে মেরে ফেলছি। আমাদের কাছে নদীর প্রকৃত সংখ্যা এবং সেই নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-গভীরতা-পানির প্রবাহের গতি সবকিছুরই পরিসংখ্যান থাকলে একটি নদীকে কেউ সহজে মেরে ফেলতে পারত না। নদীর যেকোনো পরিবর্তন সূচিত হলে তখন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত।

ভরা বুড়িগঙ্গায়ও প্রাণ নেই

নদী আমাদের বেঁচে থাকার আশা, ভরসা। আমাদের প্রকৃতির সুরক্ষা ও নান্দনিকতার জন্য বড় নিয়ামক, অথচ সরকার থেকে শুরু করে জনগণ কেউ নদী সুরক্ষায় আন্তরিক নয়। বাংলাদেশের স্বাদু পানির নদী আমাদের বিশাল সম্পদ। বিশ্বব্যাপী স্বাদু পানির উৎস কমে যাচ্ছে, তাই উন্নত বিশ্ব নদ-নদী, খাল-বিল, জলাধার রক্ষা করছে আইন ও আন্তরিকতা দিয়ে।

 

সাজেদ/

আর্কাইভ