• ঢাকা বুধবার
    ০৭ মে, ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

সুন্দরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল সংকট, ধুঁকছে স্বাস্থ্যসেবা

প্রকাশিত: মে ৭, ২০২৫, ০৮:৪০ পিএম

সুন্দরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল সংকট, ধুঁকছে স্বাস্থ্যসেবা

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

গাইবান্ধার উত্তর প্রান্তে তিস্তা নদীবিধৌত জনপদ সুন্দরগঞ্জ। ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই উপজেলায় প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষের বসবাস। অথচ আধুনিক চিকিৎসাসেবার আশায় এই বিপুল জনগোষ্ঠীর একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল ‍‍`সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স‍‍` নিজেই এখন চিকিৎসার অপেক্ষায় ধুঁকছে। চিকিৎসক নেই, সেবিকাও নেই। অপারেশন থিয়েটার কার্যত অচল। জরুরি বিভাগের সেবাও চরমভাবে ব্যাহত। চিকিৎসা নিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন হতাশ হয়ে।

সরকারি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন এখন নিজেই এক অসুস্থ শরীর– জরুরি শুশ্রূষার অপেক্ষায়। চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ন্যুব্জ হয়ে পড়া হাসপাতালটি কার্যত চিকিৎসাহীন। প্রতিটি ওয়ার্ড, করিডোর আর বহির্বিভাগে রোগীর উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু নেই পর্যাপ্ত সেবা। অসহায় মুখগুলো যেন প্রতিধ্বনিত করছে একই প্রশ্ন—‘ডাক্তার কই?’

৫০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ ৩১৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১১৭টি পদই শূন্য—শতকরা ৩৭ ভাগ! চিকিৎসক নেই, নার্স নেই, ফার্মাসিস্ট নেই, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স চালানোর মতো ড্রাইভারও নেই। রোগী আসছে প্রতিদিন, কিন্তু সেবা কোথায়?

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৯টি মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ৫টি পদ শূন্য। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের চেয়ার বহুদিন ধরেই খালি। হোমিও চিকিৎসক প্রেষণে রয়েছেন। ১১টি জুনিয়র কনসালটেন্ট পদের ৯টি, ১৩টি সহকারী সার্জনের ১০টি এবং ১৭টি উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের সবগুলো পদ শূন্য। যা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ সংকট।

এছাড়া পরিসংখ্যানবিদ, হেলথ এডুকেটর, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব ও ফিজিও), কার্ডিওগ্রাফার, বাবুর্চি– সবাই ‘নেই’-এর তালিকায়। ৮৫ জন স্বাস্থ্য সহকারীর মধ্যে ৩১টি পদই ফাঁকা। শুধু চিকিৎসক নয়, সহায়ক ব্যবস্থাপনাও মারাত্মক হারে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন শত শত রোগী। অনেকেই সকাল ৮টায় এসেও দুপুর গড়িয়ে গেলেও ডাক্তার দেখাতে পারেননি। কারও মুখে বিরক্তি, কারও চোখে ক্লান্তি। হাসপাতালের করিডোরজুড়ে অসুস্থ মানুষ আর তাদের স্বজনদের নিঃশব্দ উৎকণ্ঠা যেন জমাট বাঁধা হতাশায় রূপ নিয়েছে।

জরুরি বিভাগে একটি চেয়ারে হেলান দিয়ে ছটফট করছিলেন এক বৃদ্ধা রোগী। তার মেয়ে আয়েশা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সকাল থেকে মাকে নিয়ে বসে আছি, ডাক্তার একবারও এসে দেখেননি। কাকে বলব? সবাই বলে ডাক্তার নাই, অপেক্ষা করেন। কিন্তু একজন বৃদ্ধা মানুষ কতক্ষণ এমন কষ্ট নিয়ে বসে থাকবে?’

এক বৃদ্ধ রোগীর ছেলে আরিফুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভেবেছিলাম সরকারি হাসপাতালে অন্তত জরুরি বিভাগে একটু সাড়া পাওয়া যাবে, কিন্তু এখানে আসার পর দেখি আমরা যেন কেউ না। সরকারি হাসপাতাল হলেও কোনো দায়িত্ববোধ নেই কারও মধ্যে।’

এমন চিত্র শুধু একজন বা দুজন রোগীর নয়– সেখানে অপেক্ষমাণ শত শত রোগীর মুখে মুখে ঘুরছে একই অভিযোগ, একই আক্ষেপ– ‘ডাক্তার কই?’

এক প্রসূতি নারীর স্বামী আব্দুল আজিজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গাইনী ডাক্তার নেই, বলছে ডেলিভারি সম্ভব না, বড় হাসপাতালে যেতে হবে। তাহলে এখানে হাসপাতাল রেখে কী লাভ?’

অপারেশন থিয়েটার কার্যত বন্ধ। নেই পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নেই সার্জন। ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন ধরে। ইনডোরে রোগী ভর্তি থাকলেও অনেক সময় চিকিৎসা পাচ্ছেন না নিয়মমাফিক।

হরিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল লতিফ চোখের পানি মুছে বলেন, ‘এই হাসপাতালে একসময় আমার বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন, আজ আমার সন্তানের চিকিৎসা হচ্ছে না ডাক্তার না থাকার কারণে।’

এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বাবুল আহমেদ বলেন, ‘সুন্দরগঞ্জ একটি বৃহৎ উপজেলা। ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলে প্রায় আট লাখ মানুষ বসবাস করেন। এত বড় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।’

উপজেলা জামায়াতের আমীর শহিদুল ইসলাম সরকার মঞ্জু বলেন, ‘সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট চরমে। সাধারণ মানুষ ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও পাচ্ছেন না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অমানবিক। একটি রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। অথচ আমাদের উপজেলায় সেটা এখন উপেক্ষিত। আমরা চাই, অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিয়ে মানুষের এই দুর্ভোগ দূর করা হোক।’

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দিবাকর বসাক বলেন, ‘এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ রোগী বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ কাগজে-কলমে ২৩টি মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে মাত্র ৭ জন কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন প্রেষণে, একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বাস্তবে মাত্র ৪ জন চিকিৎসক দিয়ে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা দেওয়া কার্যত অসম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘শূন্য পদের বিস্তারিত তালিকা ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করছি, দ্রুত পদগুলো পূরণ হলে চিকিৎসাসেবার মান অনেকটাই উন্নত হবে।’

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ