• ঢাকা রবিবার
    ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরিয়ে দাও

প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২৩, ০৫:৫৪ পিএম

ফিরিয়ে দাও

বনশ্রী দাস

ঘন কালো  করে কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে,
জানলার পাল্লা গুলো খুব বারি খাচ্ছিল,
তাড়াহুড়ো করে বন্ধ করতে গিয়ে আঙুলে ভীষণ জোরে চাপা লেগে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগলো,
শাড়ির আঁচল দিয়ে চেপে ধরেও রক্ত বন্ধ হচ্ছে না,
সুধাদি  দেখে নিজের তোয়ালে দিয়ে আঙুলটা চেপে ধরে চিৎকার করতেই--
বৃদ্ধাশ্রমের ক্যেয়ারটেকার মিতা এসে  আঙুলে ওষুধ লাগিয়ে অনেকটা তুলো দিয়ে বেশ ভালো করে ব্যান্ডেজ করতে করতে বলল "ভীষণ লেগেছে দিদি ?"
আমি জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে অলীক খেয়ালে বললাম "না "
মিতা  আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেল,সুধাদি আমার রুম মেট,ব্যান্ডেজের ওপর হাত বুলিয়ে নিজের খাটে গিয়ে বসল।
আমি জানলার বাইরের দিকে চেয়ে প্রকৃতির প্রলয় দেখতে দেখতে মনে হল হৃদয় গভীরের ক্ষতটা আজ দগদগে ঘা ,পচঁন ধরেছে ,দুর্গন্ধ ছড়াছে,ঘা থেকে অবিরাম টাটকা রক্ত পুঁজ ঝরছে,আমি অসাড় --
সামান্য কোনো আঘাতে আমার আর কোনো যায় আসে না--
আমার আবেগ অনুভূতিতে কেমন শিথিলতা এসেছে-
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ,কান বধির করা বজ্রপাত ফেলে আসা  জীবন স্রোতে আমাকে জোর করে ভাসিয়ে দিচ্ছে---


একটু ঝড় বৃষ্টি,বিদ্যুৎ চমকালে  বজ্রপাত হলে , বাবান ভীষণ ভয় পেত,আমায় জড়িয়ে ধরে বলত "মা আমায় শক্ত করে ধরো ভয় লাগছে",
আমি আদর করে বলতাম " আমি আছি না,কোনো ভয় নেই সোনা "--
কত রাত আমি জেগে কাটিয়েছি ওর শরীর খারাপ হলে,ওর পরীক্ষার সময়ে---
যখন ও পি এইচ ডি করছে তখনও বাড়ি এলেই বলতো  "মা আজ তুমি আমার সাথে রাত জাগলে কিছু পেন্ডিং লেখা গুলো কম্পলিট করে নিতাম"।
ওর এই স্বভাব দেখে আত্মীয়দের, ওর বাবার ,প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হত।
বিয়ের পরে আমায় চাকরি করতে দেয়নি ওর বাবা,
পরিষ্কার করে বলেছিল " আমার ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করতে হবে--
আমার মা বাবার দায়িত্ব নিতে হবে,আমি যা উপার্জন করি তোমায় রাজ রানীর মত রাখার ক্ষমতা রাখি "।
নিজের আশা আকাঙ্ক্ষার যবনিকা পাত হল,মরচে পড়ল আমার সব উপচে পড়া  স্বপ্নের ওপর---
সংসার আর ছেলে মানুষ করা তখন আমার ধ্যান জ্ঞান---
ওর বাবার ব্যস্ত প্রফেশন, ছেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার ওপর। 
জন্মদিনে বাবান কখনোই বাইরের খাওয়ার পছন্দ করতো না,
কেক থেকে পায়স সব কিছুই আমি নিজে হাতে করে দিয়েছি এত দিন--
কিন্তু এখন আমার হাতের রান্না আমার ছেলের আর ভালো লাগে না--
এমন কি এখন ও জন্ম দিনেও আর পায়েস খাওয়ার সময় পায় না।
এত কাল আমার স্বামীর পরিচয়ে আমি পরিচিত ছিলাম সংসারে,সমাজে--
আজ বাবানের মা হিসেবে আমার পরিচয় সর্বত্র।  বাবান এখন  সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, বিলাস বহুল বাড়ি,গাড়ি ও  ঘর ভর্তি চাকর বাকর----
রাজ প্রাসাদের মত অট্টালিকায় আমি  বেমানান---
বুড়ি ব্যেকডেটেড মা সাথে থাকলে স্বাধীন ভাবে লাইফ লিড করা,স্টেটাস মেনটেন করা কি যায়?


বাবান তোর রাজপ্রসাদে কত কাজের লোকের থাকার জায়গা আছে,তোর পোষ্য কুকুরের থাকার জায়গা আছে কিন্তু----
আজ এই ঝড়ের কাছে ,প্রকৃতির কাছে ,সৃষ্টি কর্তার কাছে আমার একটাই দাবি ফিরিয়ে দাও আমার যৌবন, ফিরিয়ে দাও আমার সুস্থতা,আমার কর্মক্ষমতা, আমার দক্ষতা,আমার দৃষ্টি শক্তি,আমার ফেলে আসা দিন গুলো---
নতুন করে আমি জীবনের শেষ থেকে শুরু করতে চাই  ,আমি  এখন নিজেকে ভালোবেসে,নিজের জন্য  শেষ কটা দিন আনন্দে বাঁচতে চাই  স্বাধীন ভাবে,মাথা উঁচু করে,কারও হুকুমের দাস হয়ে নয়।
এত দিন আমি অন্যের সুখের জন্য নিজেকে নিষ্পেষণ করে এসেছি কৃতদাসের মত--
জীবনের রক্তিম সূর্যাস্তে নিজের আমিকে সম্মান দিয়ে নতুন করে চিনতে চাই--- আমি বাঁচতে চাই--- আমি এক সমুদ্র শান্তির স্রোতে ভাসতে চাই--আমি শান্তি চাই।

আর্কাইভ