
প্রকাশিত: মে ৭, ২০২৫, ০৪:১৫ পিএম
মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ভারতের হামলার পর দুই দেশের কর্তৃপক্ষের দিক থেকেই এই অভিযানের ব্যাপারে নানা তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই বিষয়টি যথারীতি `টপ ট্রেন্ডিং` হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
দুই দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমে দুই দিকের প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে অতিরঞ্জিত ও অপ্রমাণিত দাবিও করা হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) সাহায্যে তৈরি বহু ভুয়া ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে একটি হ্যাশট্যাগ, যা নিয়ে দুই দেশেই প্রচুর মন্তব্য করা হচ্ছে, সেটি হলো `সিন্দুর`।
যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায় যে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চালানো এই অভিযানের নাম দিয়েছে `অপারেশন সিন্দুর`, তখন থেকেই এই ট্রেন্ডের সূচনা হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যমে এই নামকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
`সিন্দুর` হলো একটি হিন্দি শব্দ, বাংলায় যাকে বলা হয় `সিঁদুর`। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সধবা নারীদের কপালে বা মাথায় এই সিঁদুর পরার চল রয়েছে।
এই বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের অফিসিয়াল `এক্স` অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয়েছে, যেখানে ইংরেজিতে লেখা আছে "Operation Sindoor"।
সেখানে `O` অক্ষরের জায়গায় একটি গোল পাত্রে ভরা সিন্দুর দেখানো হয়েছে এবং অপর `O` অক্ষরে সেই সিন্দুর গড়িয়ে পড়ছে।
ভারতে হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, সিঁদুর একজন নারীর বিবাহিত থাকার প্রতীক। স্বামীর মৃত্যুর পর সেই সিঁদুর মুছে ফেলার রীতি আছে এবং এই অবস্থাকে হিন্দিকে `মাং সুনা` বা `মাং উজাড়` বলা হয়।
ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই লিখছেন, পহেলগামের হামলাকারীরা যেহেতু `ধর্ম বেছে বেছে পুরুষদের হত্যা করে হিন্দু নারীদের বিধবা করেছে`, তাই এই অভিযানের `সিন্দুর` নামকরণই সবচেয়ে উপযুক্ত।
`অপারেশন সিন্দুর` কী?
ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি বুধবার সকালে `অপারেশন সিন্দুর` নিয়ে সাংবাদিক ব্রিফিংয়ে দাবি করেন, গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে সংঘটিত হামলার জবাব দিতেই এই `সামরিক প্রত্যুত্তর` - যেটি বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়েছে।
তিনি আরও দাবি করেন, `অপারেশন সিন্দুরে`র আওতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত লস্কর-ই-তইয়েবা এবং তার ভাষায় অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করেই হামলা চালানো হয়েছে।
তবে পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তারা ভারতের এই দাবিকে অস্বীকার করে জানিয়েছেন, এসব হামলায় মসজিদ এবং আবাসিক এলাকায় শিশু ও নারীসহ মোট ২৬ জন সাধারণ বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন।
কর্নেল কুরেশি জানান, "লক্ষ্যবস্তু হিসেবে এই ক্যাম্পগুলো বাছাই করা হয় বিস্তারিত গোয়েন্দা মূল্যায়নের পর এবং নিশ্চিত করা হয় যেন কেবল জঙ্গি স্থাপনাগুলোতেই হামলা করা হয়। এসব ক্যাম্প অতীতে ভারতের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনায় ব্যবহৃত হয়েছিল।"
পাকিস্তান অতীতেও এ ধরনের অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে এসেছে এবং বলেছে যে ভারতের হামলায় সাধারণ জনগণকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, `অপারেশন সিন্দুর`-এর আওতায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও বিমান বাহিনী রাত ১টা ৫ মিনিটে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ৯টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে, যেগুলোকে `সন্ত্রাসবাদীদের অবকাঠামো` বলা হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দাবিকে অস্বীকার করে বলেছে, এই হামলায় নিরীহ নাগরিক ও মসজিদ লক্ষ্যবস্তু ছিল।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, এই অভিযানে কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি এবং লক্ষ্য নির্ধারণে সংযম দেখানো হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র দাবি করেছেন, ভারতীয় হামলার জবাবে পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
পাকিস্তান আরও জানিয়েছে, তারা এই হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে এবং জবাব দেবেও।
`অপারেশন সিন্দুর` নামের তাৎপর্য
উল্লেখ্য, গত ২২শে এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরে পহেলগামের হামলায় নিহত ২৬ জনের সবাই পুরুষ ছিলেন এবং এদের মধ্যে কয়েকজন সদ্যবিবাহিতও ছিলেন। এই প্রেক্ষাপটেই এই অভিযানের নাম `সিন্দুর` রাখা হয়েছে এবং একে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে হ্যাশট্যাগ `#PahalgamTerrorAttack` দিয়ে লিখেছে, "ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, জয় হিন্দ" - এর সঙ্গেই `সিন্দুর` শব্দটি লেখা হয়েছে।
পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের মুজফফরাবাদে ভারতের হামরায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি মসজিদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর টহল
ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআই পহেলগামের হামলায় নিহত কৌস্তভ গনবোটের বিধবা স্ত্রী সঙ্গীতা গনবোটের সঙ্গে কথা বলেছে এবং তার একটি ভিডিও শেয়ার করেছে, যেখানে তিনি বলেন, "সেনাবাহিনীর অভিযান খুব ভালো হয়েছে, এবং `অপারেশন সিন্দুর` নাম দিয়ে নারীদের সম্মান দেখানো হয়েছে। আমি এখনো মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলি।"
"আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছ থেকে এই রকম প্রতিক্রিয়ারই অপেক্ষায় ছিলাম এবং তিনি উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন!"
এর পাশাপাশি পহেলগাম হামলার ভিক্টিম মঞ্জুনাথ রাওয়ের মা-ও বার্তা সংস্থাকে বলেন, "আমরা আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি কার্যকরী জবাব দেবেন। অপারেশন সিন্দুর—এই নামটা একদম উপযুক্ত বলে মনে করি।"
উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা হরিশ রাওয়াত এক্স হ্যান্ডলে একটি ভিডিও পোস্ট করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্দেশে লিখেছেন, "আপনারা আমাদের মাথা গর্বে উঁচু করেছেন। এটি অপারেশন সিন্দুর - যারা আমাদের বোনেদের মাথার সিঁদুর মুছে দিয়েছে, তাদের আমরা কিছুতেই ছেড়ে দেব না।"
অন্য দিকে ভারত ও পাকিস্তানের মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি ও পাল্টা দাবির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এক সুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে সমর্থন জানিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ ভারতের শীর্ষ দশটি ট্রেন্ডের সবগুলোই এই হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে `অপারেশন সিন্দুর` শীর্ষে রয়েছে।
এরপর আছে `জয় হিন্দ`, `ইন্ডিয়ান আর্মি`, `ইন্ডিয়া পাকিস্তান ওয়ার`, `ভারত মাতা`, `ভারতীয় সেনা`, `এয়ার স্ট্রাইক`, `ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স` ইত্যাদি।
তবে অনেকেই আবার তথ্য যাচাই করার ও ফেইক নিইজ থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন।
সুপরিচিত ভারতীয় সাংবাদিক রানা আয়ুব এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, "ভারত-পাকিস্তান প্রসঙ্গে ইন্টারনেটে অসংখ্য ভুয়া তথ্য ও ফটোশপ ভিডিও ছড়াচ্ছে, বিশেষত এমন লোকদের থেকে যাদের আরও ভালোভাবে জানা উচিত। জনস্বার্থে, উত্তেজনা ছড়ানোর ইচ্ছাকে দমন করার চেষ্টা করুন।"
ভারতে বিরোধী দলগুলো সরকার নয়, বরং সেনাবাহিনীর প্রশংসা করছে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং সেনাবাহিনীর মনোবলের প্রশংসা করছেন।