• ঢাকা শনিবার
    ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

স্বপ্নের পদ্মা সেতু : মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা মিলে গড়ে উঠবে পর্যটন জোন

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২২, ১০:৩০ পিএম

স্বপ্নের পদ্মা সেতু : মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা মিলে গড়ে উঠবে পর্যটন জোন

দেশজুড়ে ডেস্ক

স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা মিলে গড়ে উঠবে পর্যটন জোন। আর এই পর্যটন জোনের কেন্দ্র বিন্দু হবে মেহেরপুর। পর্যটন জোন চালু হলে এই এলাকার কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী, মেহেরপুর-১ আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন বলেছেন, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে ১টি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন শিল্পের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর বাংলাদেশের জন্ম মেহেরপুরের মুজিবনগর। 

তিনি আরও বলেন, ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলেই মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স, আমঝুপি কুঠিবাড়ি, কুষ্টিয়ার রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, মরমী বাউল সাধক লালন ফকিরের আখড়া, চুয়াডাঙ্গার দর্শনার কেরু এন্ড কোম্পানি নিয়ে এই অঞ্চলের পর্যটন জোন হিসেবে গড়ে উঠবে। আর পর্যটনের কেন্দ্র বিন্দু হবে মেহেরপুর। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ স্বপ্ন বুনছে এই পর্যটন জোন ঘিরে জীবন মান বদলের। এ জন্য এই তিন জেলাকে নিয়ে পর্যটন জোন করা হবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় পর্যটকদের সমাগম বাড়বে। সরকার রাজস্ব আদায় করতে পারবে। এরই সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সুযোগ গড়ে উঠবে।’ 
  
কুষ্টিয়া জেলার অত্যন্ত আকর্ষণীয় জায়গা বিশ্বকবি রবীন্দ্রানাথের কুঠিবাড়ি। কবির জন্মদিন উপলক্ষে ২৫ বৈশাখ আয়োজিত রবীন্দ্র জয়ন্তীর উৎসবে দর্শনার্থীদের বেশি ভ্রমণ করতে দেখা যায়। মরমী বাউল সাধক লালন ফকিরের আখড়া সংস্কৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের তৎকালীন বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথগ্রহণ করেছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে আজকের মুজিবনগর। আর সেই গৌরবময় স্মৃতির ধারক হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ২৩টি কংক্রিটের সফেদ দেয়াল। পাকিস্তানি ২৩ বছরের শাসন-শোষণের দুঃসহ স্মৃতিবহ ঘটনার স্মৃতিসৌধ। 

স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৩১ আগস্ট বৈদ্যনাথতলার আমবাগানটিকে সংরক্ষণসহ ঐতিহাসিক পবিত্রতম স্থানে রূপান্তরিত করার নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণপূর্ত অধিদফতর ঐতিহাসিক এ জায়গায় জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ ও অতিথি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৮৮ সালে ১ কোটি ৯৩ লাখ ১১ হাজার ১৩৩ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালে ৬৬ একর জমির ওপর ১১টি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতর ও অধিদফতর মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ শুরু করে। মুজিবনগরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরতে ১৯৯৯ সালে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সরকারিভাবে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০০ সালে । মুজিবনগর কমপ্লেক্স এলাকা এখন অবকাশ যাপনের সুন্দর স্থান। এই প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র নির্মাণ, মানচিত্রটিকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাচিত্র, মানচিত্রে যুদ্ধকালে দেশের চারটি পথ দিয়ে শরণার্থী গমন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস, আ স ম আব্দুর রবের পতাকা উত্তোলন, শাজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, শালদাহ নদীতে যুদ্ধ, কাদেরিয়া বাহিনীর জাহাজ দখল ও যুদ্ধ, শুভপুর ব্রিজে সম্মুখ যুদ্ধ, কামালপুর ও কুষ্টিয়ার মিরপুরের যুদ্ধ, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীর হত্যাযজ্ঞ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, সচিবালয়ে আক্রমণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংস, তৎকালীন ইপিয়ার পিলখানা আক্রমণ, রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবী হত্যার চিত্র তুলে ধরা, জাদুঘর, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গ্রন্থসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, সেমিনার কক্ষ, মিলনায়তন, স্মৃতিকেন্দ্রের অফিসভবন, গ্রন্থভাণ্ডার ও বিক্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ৪০টি ভাস্কর্য নির্মাণ, জাতীয় নেতাদের তৈলচিত্র, মিলনায়তন ভবনের গায়ে টাইলসের মুরালচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঋতুকে দৃশ্যমান করে তোলা, ফোয়ারা নির্মাণ, স্বাধীন বাংলার পতাকার প্রতিকৃতি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা, মুজিবনগর সরকারের প্রতীক নির্মাণ এবং টাইলসের ফলকে মুজিবনগর সরকারের প্রচারপত্র নির্মাণ সংযুক্ত করা, মানচিত্রের দক্ষিণপাশ ঘেঁষে এন্টি ফাংগাস টায়ালস দিয়ে প্রতীকী বঙ্গপোসাগর। মানচিত্রের বাইরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।   

মুজিনগর স্মৃতিকেন্দ্রকে ঘিরে সেখানে শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। কেউ খাবার হোটেল, কেউ বিভিন্ন ধরনের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করে। মৃৎশিল্পের পসরা সাজিয়ে বিক্রেতা নুর হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন তিনি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন। ১ হাজার টাকা মতো লাভ থাকে। পদ্মা সেতু চালু হলে এখানে আরও পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। আরও বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি হবে। মানুষের কর্মসংস্তানেরও সুযোগ হবে।’

বৃটিশ আমলে নীল চাষের উদ্দেশে ইংরেজরা ৭৪ একর জমির ওপর কালের সাক্ষী মেহেরপুরের ঐতিহাসিক আমঝুপি নীলকুঠি গড়ে তোলে। মেহেরপুর অঞ্চলে ১৭৭৮ সালে ক্যারল ব্লুম  নামে এক ইংরেজ ব্যক্তি তৎকালীন নদীয়া জেলা বর্তমানে মেহেরপুরের আমঝুপির কাজলা নদীর তীরে ৩০০ বিঘা জমির উপর নীলকুঠি স্থাপন করেন। নীল চাষ অত্যাধিক লাভজনক হওয়ায় ১৭৯৬ সালে এখানে নীল চাষ শুরু হয়। এ সময় বিখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুনাথ ঘোষালির সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে গোয়ালা চৌধুরী নিহত হলে মেহেরপুর অঞ্চলে রানি ভবানীর জমিদারীভুক্ত হয়। রানি ভবানী নিহত হবার পর হাত বদল হয়ে গোটা অঞ্চলটি মথুরানাথ মুখার্জির জমিদারীভুক্ত হয়। পরে তার ছেলে চন্দ্র মোহন বৃহৎ অঙ্কের টাকা নজরানা নিয়ে মেহেরপুরকে জেমস হিলের হাতে তুলে দেন। ১৮১৮ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মেহেরপুরের বেশ কয়েকটি স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। এর মধ্যে আমঝুপি, গাংনীর ভাটপাড়া নীলকুঠি অন্যতম। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ইংরেজরা চলে যাবার সময় পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সরকারের কাছে হস্তান্তর করে যায় এই কুঠিবাড়িসহ ভূ-সম্পত্তি।

১৯৭৮ সালে ১৩ মে তারিখে খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের আমঝুপি অধিবেশনে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্কার ও উন্নয়ন করা হয়।  এই কুঠিবাড়ি দেখতেও প্রতিদিন পর্যটকের ভিড় নামে। এখানেও শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের ভিড় হবে বলে সেখানে কুটির শিল্পর পণ্য বিক্রেতা আবু হানিফ মনে করছেন। তিনি আশা করছেন পদ্মা সেতু চালু হলে এখানে আরও মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।

মেহেরপুরের পরিবহন ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর আমঝুপি, মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্র, কেরু এন্ড কোম্পানি ও শিলাইদহে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি মিলে পর্যটন কেন্দ্র চালু হলে তিনি এই পর্যটনগুলোকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের সুবিধার্থে বাস সার্ভিস চালু করবেন। নিজস্ব গাইডও রাখবেন।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খান বলেন, ‘জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী পর্যটন জোন গড়তে জোর চেষ্টা করছেন। পদ্ম সেতু চালু হলে মেহেরপুরে মানুষের সমাগম বাড়বে। কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে অনেক মানুষের।  অনেকে উন্নমানের হোটেল-মোটেল গড়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।’

এসএ/এএল
আর্কাইভ