• ঢাকা সোমবার
    ২৫ আগস্ট, ২০২৫, ৯ ভাদ্র ১৪৩২

এলডিসি থেকে উত্তরণ ৬ বছর পেছাতে চায় ব্যবসায়ীদের ১৬ সংগঠন

প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২৫, ০৪:৩২ পিএম

এলডিসি থেকে উত্তরণ ৬ বছর পেছাতে চায় ব্যবসায়ীদের ১৬ সংগঠন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

২০২৬ সাল থেকে পিছিয়ে দিয়ে ২০৩২ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ দাবি করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এলডিসি উত্তরণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বাড়তি তিন বছর এবং ট্রানজেকশন পিরিয়ড হিসেবে তিন বছর চাওয়া হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, এলডিসি থেকো উত্তরণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। তবে তারা মনে করে, সফল ও টেকসই উত্তরণের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছর অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন। তাদের দাবি, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আজ রোববার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ‘এলডিসি থেকে উত্তরণে: আগামীর চ্যালেঞ্জ’  সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়েছে। যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ জাতীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।

সংবাদ সম্মেলনে আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তোরণের পথে রয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী সমাজের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এলডিসি থেকে উত্তরণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। তবে সার্বিক প্রস্তুতির জন্য এ সময়সীমা পিছিয়ে দিয়ে ২০৩২ সালে উত্তোরণের দাবি করেন তারা।

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সফল ও টেকসই উত্তরণের জন্য অন্তত তিন থেকে পাঁচ বছরের অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন। বাড়তি সময়ের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আঘাত মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, আসিয়ান জোট এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি নিশ্চিত করা যায়।

ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), চামড়া, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং হালকা প্রকৌশল খাতে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যেন অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আসে। গুণগত মানসম্পন্ন প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যেখানে বিনিয়োগকারীরা শুধু মূলধন নয়, টেকসই প্রযুক্তি ও উন্নয়ন কৌশল নিয়ে আসবে।

সুশাসন জোরদার এবং জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি করা যেন অস্থির বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও প্রতিযোগিতামূলক থাকা যায়।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- আইসিসিবির সহ-সভাপতি এ. কে. আজাদ, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি. রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি হয়েছেন রাজীব এইচ চৌধুরী, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, উত্তরণের সঙ্গে আসছে নতুন দায়িত্ব ও ঝুঁকি। এগুলো হচ্ছে-শুল্কমুক্ত বা ডিউটি-ফ্রি বাজারসুবিধা হারানো: এলডিসির কাতার থেকে উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ বড় বড় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। এর ফলে রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যেতে পারে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিশেষ সুবিধার অবসান এলডিসি হিসেবে যে বিশেষ সুবিধাগুলো পাওয়া যেত, যেমন রপ্তানিতে ভর্তুকি ও বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্বের চুক্তি বাস্তবায়নে শিথিলতা, সেগুলো আর পাওয়া যাবে না। ফলে ওষুধশিল্পে পেটেন্টের নিয়ম আরও কঠোর হবে, যা উৎপাদন খরচ বাড়াবে, বাড়াবে ওষুধের দাম।

আরও জানানো হয়, কাঁচামালের উৎসবিধি বা রুলস অব অরিজিন কঠোর হবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত থেকে দেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশেরও বেশী অর্জিত হয়।

ব্যয়বহুল ঋণ: সহজ শর্তের ঋণ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাজারভিত্তিক ঋণ নিতে হবে, এতে করে ঋণ শোধের চাপও বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের আওতাধীন আইডিএর নমনীয় ঋণ বা সফট লোন পাওয়ার সুবিধাও হারাবে।

লিখিত বক্তব্যে ওষুধ শিল্পের বিষয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মেটায়। পাশাপাশি ১৫০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশি ওষুধ রপ্তানি করা হয়। তবে এই খাতের জন্য এখনো পেটেন্ট ছাড় খুব দরকার। যদি অন্তত আরও ৬ বছর প্রস্তুতির সময় না পাওয়া যায়, তবে ক্যান্সার ও ভাইরাসজনিত রোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের দাম অত্যধিক বেড়ে যাবে, যা জনস্বাস্থ্য ও রপ্তানি প্রতিযোগিতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

আরও বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশ ২০৩৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ট্রিপস ওয়েভারের সুবিধা পাচ্ছে (বা এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন না হওয়া পর্যন্ত যেটি আগে ঘটে)। কিন্তু বাংলাদেশ যদি ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়, তবে এই হাড় আর থাকবে না। তখন ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পকে পূর্ণ পেটেন্ট আইনের অধীন হতে হবে, যা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। যেমন: ক্যান্সারের ওষুধ ইমাটিনিব ৩০-৪০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে মাসে ২,০০০ থেকে ৩,০০০ মার্কিন ডলার হতে পারে। এইচআইভি ওষুধ বছরে ১০০-১৫০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার হতে পারে। বায়োটেক ওষুধও কয়েকগুণ ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।

তৈরি পোশাক খাতের বিষয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশের বেশি জোগান দেয়। কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই খাতকে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা শেষ হবে, উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং নিয়মকানুন আরও কঠোর হবে। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি, যেন শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থাকতে হয় এবং বৈশ্বিক বাজারের ধাক্কা সামলানো যায়। পোশাক শিল্পের বাইরে অন্যান্য খাতে রপ্তানি বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ নতুন প্রবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে পারবে, কর্মসংস্থান সুরক্ষিত হবে এবং উত্তরণের পরও অর্থনীতি টেকসইভাবে এগোবে।

এতদিন বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন আলাদাভাবে এ দাবি জানিয়ে আসলেও এবার দেশের ১৬টি শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন একযোগে এ দাবি জানালো। এলডিসি উত্তরণ পেছানোর দাবি জানানো সংগঠনগুলো হচ্ছে- ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি), বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই), মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি), চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই), তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই), নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)।

আর্কাইভ