
প্রকাশিত: মে ৩, ২০২৫, ১২:৫৮ এএম
পহেলগাঁওয়ে হামলার ঘটনা রীতিমতো থমকে গেছে অনেকের জীবন। প্রতিনিয়ত খেটে খাওয়া মানুষটির পকেট প্রায় শূন্য। এদের একজন কাশ্মীরের ৪০ বছর বয়সি ট্যাক্সিচালক রমিজ আহমেদ। বললেন, ১২ দিন ধরে কোনো অর্থ উপার্জন করতে পারছেন না। সারাক্ষণ কাজ করছে ভয়। ভারত-পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনা নিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু আতঙ্ক তৈরি করে না, বরং আমাদের জীবিকার একমাত্র উৎস ধ্বংস করে দেয়। তবে শুধু রমিজই নন, পহেলগাঁও ঘটনায় থেমে গেছে এমন আরও বহু কাশ্মীরির আয় রোজগারের পথ।
রমিজ বলেন, পর্যটকদের সংখ্যা এতটাই কমে গেছে, দিনে একটি যাত্রীও পাওয়া যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করি; কিন্তু কেউ আসে না। আশা ছিল এ বছর ভালো আয় হবে। বুকিংও বাড়ছিল; কিন্তু এখন সবকিছু ভেঙে পড়েছে। আমি ভয় পাচ্ছি যে যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে আমার মতো লোকেরা, যাদের কোনো সরকারি চাকরি নেই, জমি নেই, কোনো ব্যবসা নেই, তারা নিঃস্ব হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, আমার কাছে পেছনে ফিরে যাওয়ার মতো সঞ্চয় নেই। আমার একটি পরিবার আছে, যাদের আমার দেখতে হবে। সন্তানদের পড়াশোনা করাতে হবে। ঋণ পরিশোধ করতে হবে। যখন পর্যটকরা আসেন না, পরদিন আমরা কীভাবে খাব, সেই প্রশ্নও ওঠে। পহেলগাঁও ঘটনায় ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এক ভুক্তভোগী আশিক নবী (৩৫)। তিনি একজন অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর অপারেটর।
তিনি বলেন, এ হামলার ঘটনায় তাৎক্ষণিক পরিণতি আমি ভোগ করেছি। হামলার পর সরকারের সব ট্রেকিং কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে ৪৮টি পর্যটনকেন্দ্র। এটি আমার কাজের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। হামলার কারণে ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই, আর্থিক ক্ষতি এবং স্থানীয় গাইড ও পরিষেবাকর্মীদের বরখাস্ত করতে হয়েছে। এ মুহূর্তে আমার জীবিকানির্বাহ নিয়ে খুব চাপে আছি; কিন্তু আশা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। ২১ বছর বয়সি আজমল বিহারের অভিবাসী শ্রমিক।
তিনি বলেন, আমার বোন এক দশকেরও বেশি সময় তার স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে কাশ্মীরে বসবাস করছেন। কয়েক বছর আগে তিনি আমাকেও এখানে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কখনো কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার অভিযোগ করেননি। বাস্তবে তিনি সর্বদা স্থানীয়দের এবং তাদের উষ্ণতার প্রশংসা করতেন। এটাই আমাকে এখানে এসে জীবন গড়ার চেষ্টা করতে উৎসাহিত করেছিল। আমি গাড়িতে করে পানিপুরি (দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনপ্রিয় রাস্তার খাবার) বিক্রি করি এবং জীবিকানির্বাহ করি। এখানকার আবহাওয়াও ভালো। যখন পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে, তখন প্রথমদিনই ভয় তৈরি হয়েছিল। কী হবে, তা না জেনে আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমি আমার স্টল চালাচ্ছি; কিন্তু সন্ধ্যার পর স্টল বন্ধ করে দিচ্ছি। তবে কাশ্মীরিদের ওপর ক্ষয়ক্ষতি যে শুধু সেই অঞ্চলেই চলছে, তা নয়। ভারতজুড়ে ব্যবসায় ক্ষতি ও অত্যাচারের স্বীকার হচ্ছেন তারা। কাশ্মীরের বাসিন্দা শাবির আহমেদ দার ২০ বছরেরও বেশি সময় পশমিনা শাল বিক্রি করে আসছেন।
উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডের শহর মুসৌরিতে কাজ করেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলো তার কাছে অভিশাপের মতো মনে হচ্ছে। রোববার দার এবং অন্য একজন বিক্রয়কর্মীকে হিন্দু ডানপন্থি গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রকাশ্যে হয়রানি এবং লাঞ্ছিত করেছে। হামলার একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দার ও তার বন্ধুর দোকানটি ভাঙচুর করার সময় তারা তাদের মারধর এবং গালাগাল করছে।
দার বলেন, ‘তারা আমাদের ওপর হামলার জন্য দোষ চাপিয়েছে, শহর ছেড়ে চলে যেতে এবং আর কখনো মুখ না দেখাতে বলেছে।’ তিনি আরও জানান, তার হাজার হাজার ডলার মূল্যের জিনিসপত্র এখনো সেখানে পড়ে আছে। কিন্তু সেগুলো আনতে খুব ভয় পাচ্ছেন তারা। কাশ্মীরের আরও এক বাসিন্দা সাফিয়া জান (৪০)। তিনি বলেন, ‘আমি মূলত (পাকিস্তানের) করাচির বাসিন্দা। ২০১৪ সালে আমি (ভারতীয়) সরকার কর্তৃক ঘোষিত পুনর্বাসন নীতির অধীনে কাশ্মীরে আসি। আজ যখন শুনি যে পাকিস্তানি বাসিন্দাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, তখন আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। আমার হৃদয় ভেঙে যায়। আমি ফিরে যেতে চাই না। আমি কীভাবে আমার স্বামী ও সন্তানদের পেছনে ফেলে একা ফিরে যেতে পারি? পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভালো। আমি হাত জোড় করে সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাদের তাড়িয়ে দেবেন না। আমার মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করছে। আমরা বছরের পর বছর কাশ্মীরে একটি জীবন গড়ে তুলেছি। আমরা কারও জন্য হুমকি নই। আমরা কেবল চাই শান্তিতে, পরিবার হিসাবে একসঙ্গে বসবাস করা।
তথ্যসূত্র: আলজাজিরা ও বিবিসি।