• ঢাকা শুক্রবার
    ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১২ হাত বদলে শহর যাত্রায় যেভাবে ঢাকায় পৌঁছে শত টাকার ডাব!

প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২৩, ০৭:২৬ পিএম

১২ হাত বদলে শহর যাত্রায় যেভাবে ঢাকায় পৌঁছে শত টাকার ডাব!

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ডাবের আবেদন কিন্তু এখনও এক ফোঁটা কমেনি বরং বেড়েছে। পানীয়ের তালিকায়ও ডাবের অবস্থান উপরের দিকেই থাকে। আর হবেই না বা কেন, ডাবের অবদান কোন দিক থেকে কম? পুষ্টিগুণ বলি কিংবা রূপচর্চা – সবেতেই ডাব অন্যসব ফলকে ছাড়িয়ে অগ্রভাগে থাকে।

ধরুন, তীব্র ছাতি ফাটা গরমে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। হাঁটতে গিয়ে তৃষ্ণা পেলে কী খেতে ইচ্ছে করবে, বলুন তো? পানি, ফলের জুস, ডাবের পানি, ঠান্ডা কোমলপানীয়সহ সব ধরণের পানীয়ই বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে আপনার সামনে। আপনি কোনটি বেছে নেবেন?

যদি ডাব বেছে নেন, তাহলে বোঝা যাবে সত্যিকারের ভালোবাসা বেছে নিয়েছেন। কারণ ইংরেজিতে একটা কথা রয়েছে- "ট্রু লাভ ইজ ওয়ান কোকোনাট অ্যান্ড টু স্ট্র‍‍`জ।" অর্থাৎ, একটি ডাব ও দুটি স্ট্র হলো- প্রকৃত ভালোবাসা। আসলেই কী তাই? যখন রাস্তার ধারে কিংবা সমুদ্দুরের ধারে দাঁড়িয়ে দুটি স্ট্র সমেত যুগলেরা ডাবের পানি পান করেন, তখন তা বোধহয় অদ্ভুত রকমের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করে। হয়তো ডাবের সম্মিলনে এই পরিবেশই সৃষ্টি করে ভালোবাসা।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ডাবের আবেদন কিন্তু এখনও এক ফোঁটা কমেনি বরং বেড়েছে। পানীয়ের তালিকায়ও ডাবের অবস্থান উপরের দিকেই থাকে। আর হবেই না বা কেন, ডাবের অবদান কোন দিক থেকে কম? পুষ্টিগুণ বলি কিংবা রূপচর্চা – সবেতেই ডাব অন্যসব ফলকে ছাড়িয়ে অগ্রভাগে থাকে।  

ডাব নিয়ে যতোই ‍‍`রোমান্টিসিজম‍‍` থাকুক না কেন – ডাবের উৎপত্তি খুঁজতে গেলে উঠে আসে অনেক পুরোনো ইতিহাস। ডাব বা নারকেলের ইংরেজি রূপ ‍‍`কোকোনাট‍‍` শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ শব্দ ‍‍`কোকো‍‍` থেকে। প্রথমদিকের স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা পনের শতকে নারকেলকে অভিহিত করতেন ‍‍`কোকোস‍‍` বা ‍‍`বানরের মুখ‍‍` হিসেবে।


অনেক উদ্ভিদবিদের ধারণা, ডাবের উৎপত্তি হয়েছিলো পাপুয়া নিউগিনিতে। আবার অনেকে মনে করেন এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলই বুঝি ডাবের প্রথম উৎপত্তিস্থল। পরবর্তী সময়ে শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ওশেনিয়া, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ঘানাসহ পৃথিবীর প্রায় ৯৩টি দেশে এর বিস্তার ঘটে। উৎপত্তিস্থল যাই হোক, বর্তমানে বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ ডাব বা নারকেল সরবরাহ হয় ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ফিলিপাইন থেকে।

বাংলাদেশে ডাবের উৎস
বাংলাদেশে লক্ষ্মীপুর, বাগেরহাট, নাটোর অঞ্চলে নারকেল বা ডাবের চাষ হয়। স্থানীয় ভাবে জানা যায়, দেশের মোট নারকেল উৎপাদনের বড় অংশই উৎপাদন হয় উপকূলীয় লক্ষ্মীপুর জেলায়। ১৪৫৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের লক্ষ্মীপুর জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ডাব বা নারকেল গাছ। এতদিন নারকেলের জন্য এ জেলার সুনাম থাকলেও এখন ডাবের জন্যও সারাদেশে সুপরিচিত লক্ষ্মীপুর।


প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে মূলত ডাব বা নারকেলের ফলন ভালো হয়। উপকূলীয় উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া ডাব বা নারকেল চাষে অতি উপযোগী। সফলভাবে চাষ সম্প্রসারণের জন্য যে অনুকূল জলবায়ু দরকার তার সবই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিরাজ করে। তাছাড়া ডাব গাছের জন্য মাটি নিয়েও কোনো সমস্যা হয় না। যেকোনো মাটিতেই এর ফলন ভালো হয়।

বাংলাদেশ কৃষি সার্ভিসের তথ্য অনুসারে, তারা বারী নারকেল-১ এবং বারী নারকেল-২ নামে দুটি জাত অবমুক্ত করেছে। দুটি জাতই আকারে লম্বা ও মুক্ত পরাগায়িত। উপকূলীয় অঞ্চলের ভেতরে এই দুই জাতের ডাব সম্প্রসারণ করার যোগ্য।

ডাব ও নারকেলের পার্থক্য
ডাব ও নারকেল আদতে একই ফল হলেও অনেকে এর পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নন। নারকেল হলো ডাবের পরিপক্ক রূপ। ডাব পেকে গেলে তা নারকেলে রূপান্তরিত হয়।

ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম ও সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে; যা শরীরের জন্য ভীষণ কার্যকরী। আকারভেদে একেকটি ডাবে থাকতে পারে  ২০০ থেকে ১০০০ মিলিলিটার পর্যন্ত পানি। এছাড়াও অ্যামিনো অ্যাসিড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আয়রনসহ অনেক পুষ্টি উপাদান থাকে ডাবের পানিতে।

ডাব যখন নারকেলে রূপান্তরিত হয়, তখন এরমধ্য থেকে পানির পরিমাণ অনেকখানি হ্রাস পায়; যার ফলে মোটা শাঁস তৈরী হয়। ফলস্বরূপ, ডাবের পানি থেকে পুষ্টি হিসেবে যে পরিমাণ খনিজ পাওয়া যেতো, সেটি নারকেল হওয়ার পর সেসব কিছুর পরিমাণও হ্রাস পায়। যার জন্য নারকেলের পানির তুলনায় ডাবের পানি বেশি পুষ্টিকর বলে ধরা হয়।

কেন তড়তড়িয়ে বাড়ছে ডাবের দাম
সময়ের সাথে সাথে ডাবের উৎপাদন বাড়লেও – ডাবের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে বেজায় আক্ষেপ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই লাগামহীনভাবে বাড়ছে ডাবের দাম। শহরের বাইরে যে ডাবের দাম ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা, তা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে আসলে দাঁড়ায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। শহরে আসলেই মূল্য বেড়ে যায় প্রায় ৪ গুণ। তাই দামের কারণে যে কেউ ইচ্ছে করলেই ডাব কিনতে পারছেন না।

কমলনগর উপজেলার তোরাব আলী মিয়ার খামার বাড়িতে রয়েছে ১৫শ নারকেল গাছ। এ বাড়ি থেকে প্রতি দেড় থেকে দুই মাস পর পর ডাব বিক্রি করা হয়। প্রতিবারে বিক্রি হয় ২ থেকে ৩ হাজার ডাব। তিনি জানান, গত কয়েকমাস আগে প্রতি হাজার ডাব ২৮ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেছেন স্থানীয় এক পাইকারের কাছে। বর্তমানে তার বিক্রয়মূল্য ৩৫ হাজার টাকা। খামারের বয়স প্রায় শত বছর হলেও – গত ২ বছর যাবত নারকেলের পরিবর্তে ডাব বিক্রি করে দিচ্ছেন তিনি।


ব্যবসায়ী নুরুল আমিন মিয়া বলেন, শহরে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় ডাব কিনে খেলেও গত ২ বছরের মধ্যে কখনো ২৮-৩৫ টাকার বেশি মূল্যে ডাব বিক্রি করতে পারেননি তিনি।

ব্যবসায়ীদের ধারণা- লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলায় প্রায় ৭০ জন ডাবের ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারা স্থানীয় বাজার ও বাগান থেকে ডাব কিনে বড় শহরে নিয়ে পাইকারি বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাইকারি ডাব ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ৩-৪ লাখ পিস ডাব বড় শহরে বিক্রি হয়। কিন্তু, রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে এর পরিমাণ দাঁড়ায় দৈনিক কমপক্ষে ৭ লাখ পিস।

ডাবের পরিবহন চক্রে বাড়ছে দাম

ব্যবসায়ীদের মতে, গ্রাম থেকে শহরের একজন ক্রেতার হাতে এক একটি ডাব পৌঁছাতে এরমধ্যে প্রায় ১২ বার হাত বদল হয়। প্রতিটি হাতেই থাকে লাভের হিসাব। আবার, ডাব প্রতি ২০-৩০ টাকা লাভ নেয় শহরের মধ্যসত্ত্বভোগী কিংবা আড়ৎদার।

লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের মেঘনা বাজারের ডাবের স্থানীয় আড়ৎদার ও ডাব ব্যবসায়ী মোঃ রবিউল আলম ১৬ বছর যাবত ডাবের ব্যবসা করছেন। তিনি স্থানীয় বাগান মালিক ও ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের থেকে ডাব কিনে পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লার বড় পাইকারি আড়তে বিক্রি করেন।

রবিউল বলেন, প্রথমত, তারা বাগানের বা বাড়ির মালিকদের থেকে বর্তমানে প্রতিটি ডাব গড়ে কিনেছেন ৩৫-৪৫ টাকায়। দ্বিতীয়ত, গাছ থেকে প্রতিটি ডাব নামাতে স্থানীয় পাড়িয়াদের (যারা গাছ থেকে ডাব কাটে) জন্য খরচ করতে হয় ৩-৪ টাকা। তৃতীয়ত, যারা গাছের গোড়ায় রশি ধরে এবং ঝরা ডাব এক স্থানে জড়ো করে তাদেরকে দিতে হয় ডাব প্রতি ৪০-৫০ পয়সা। চতুর্থত, স্থানীয় ভ্যানচালক বা ছোট ট্রাক ড্রাইভারকে দিয়ে স্থানীয় আড়তে জড়ো করতে খরচ ২ টাকা।

সদরঘাটে নৌকায় করে আসছে ডাবের চালান।
এরপর শুরু হয় ডাব ঢাকায় নিয়ে আসার কর্মযজ্ঞ। পঞ্চম হাত হিসেবে ডাব ট্রাক যোগে ঢাকার আড়তে পৌঁছাতে খরচ হয় আরো ৪-৫ টাকা। তখন আড়তের শ্রমিকদের দিতে হয় ৪০-৫০ পয়সা। আড়তে পর্যন্ত পৌঁছাতে একজন স্থানীয় ব্যবসায়ীর প্রতিটি ডাবে খরচ হয় ১০-১৪ টাকা। যখন স্থানীয় একজন বিক্রেতা ঢাকার বাজারে যখন ডাব নিয়ে পৌঁছান, তখন বাগানে কেনা ৩৫ টাকা দামের ডাবের মূল্য দাঁড়ায় কমপক্ষে ৫৫ টাকায়। তার সাথে নিজের খরচ, বিনিয়োগ এবং শারীরিক পরিশ্রম মিলে জেলার একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী ৪-৫ টাকা লাভে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা আড়ৎদারদের নিকট ডাব বিক্রি করেন গড়ে ৬০ টাকায়। এরপর অষ্টম হাত হিসেবে বড় শহরের আড়ৎদারদের কাছে ডাব পৌঁছায়।

রবিউল আলম আরো জানান, "গ্রাম থেকে অনেক রকম কষ্ট করে ডাব নিয়ে বড় শহরে এনে আমরা সর্বোচ্চ ৪-৫ টাকা লাভ করি। কিন্তু, আমাদের চোখের সামনে শহরের আড়ৎদাররা নবম হাত হিসেবে ভ্যান চালক কিংবা ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে ২০-৩০ টাকা লাভে ডাব বিক্রি করেন। মাঝেমধ্যে আরো ২টি জায়গায় ডাবপ্রতি টাকা খরচ করতে হয়। সবশেষে একজন গ্রাহক ভ্যানে করে ডাব বিক্রয়কারীদের ১০-২০ টাকা লাভ দিয়ে ডাব কিনে খায় ১০০-১৫০ টাকায়। এইভাবে ১২টি হাত বদল হয়ে ডাব শহরে পৌঁছায়।

বরিশাল থেকেও একইভাবে কয়েক হাত বদলের পর ডাব ঢাকায় এসে পৌঁছায়। সেখানেও খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে ডাব চাষীরা সবসময় ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। ঝালকাঠি সদরের ডাবের পাইকারি কালেক্টর হুমায়ুন কবির বলেন, "প্রথমে বাগান থেকে একটি ডাব বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ টাকায়। এরপর তা স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি করা হয়"।

বরিশালের আরেকজন পাইকারি ডাব সরবরাহকারী মিজানুর রহমান জানান, পরবর্তী সময়ে ডাব ঢাকায় পাঠানো হয় এবং তা গ্রীষ্মকালে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তিনি আরো বলেন, "সাধারণত গ্রীষ্মকালে ডাবের দাম তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়"। এর মূল কারণ হিসেবে অবশ্য ডাব গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকেই চিহ্নিত করেছেন তিনি।

বরিশাল থেকে ডাব ঢাকার কদমতলীতে আসার পর তা বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করা হয়। খুচরা দোকানে যেগুলো ৮০ থেকে ১০০ টাকা মূল্যে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।

কমে যাচ্ছে নারকেলের উৎপাদন
ডাবের চাহিদা বাড়ার কারণে কমে যাচ্ছে নারকেলের উৎপাদন। নারকেল চাষী ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. হাসান শরীফ জানান, "কোমলপানীয় হিসেবে অতীতে সব সময়ই কমবেশি ডাবের চাহিদা ছিল। কিন্তু, দেশব্যাপী করোনাসহ বিভিন্ন জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়ায়– প্রচুর পরিমাণ ডাবের চাহিদা তৈরি হয়েছে। চাহিদার সাথে সাথে ডাবের দাম নারকেলের চেয়ে দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীরা এখন গাছশুন্য করে ডাব বিক্রি করে ফেলছে। এতে বাণিজ্যিক পর্যায়ে নারকেল উৎপাদন প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে দেশব্যাপী অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে ডাবের দাম।

রামগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের ফরিদ আহমেদ জানান, "নারকেলের তুলনায় ডাবে বেশি টাকা পাওয়া যায় তাই বাগানের মালিকরা এখন সারা বছরই ডাব বিক্রি করে দিচ্ছেন। বছরে ৬-৭ বার ডাব বিক্রি করা যায়। কিন্তু, নারকেল বিক্রি করা যায় বছরে ২ বার; এখন ডাবে-ই আয় বেশি।"

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজারের নারকেল উৎপাদনকারী আলাউদ্দিন সাজু জানান, যেখানে একটি ডাব উৎপাদনে সময় লাগে মাত্র দেড় থেকে দুই মাস। সেখানে একটি নারকেল উৎপাদনে সময় লাগে কমপক্ষে ৪ মাস। তাই চাষীরা এখন ডাবই বিক্রি করছেন।

অন্যদিকে, হায়দারগঞ্জ বাজারের নারকেল ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানায়, বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক গাছ শুন্য করে ব্যাপক হারে ডাব বিক্রি করে ফেলছেন। এতে লক্ষ্মীপুরসহ সারাদেশে নারকেল কেন্দ্রিক অন্তত ৫টি শিল্পে ব্যাপক বিপর্যয়ের আশংকা তৈরি হয়েছে। ডাব বিক্রির কারণে নারকেলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রভাব পড়তে পারে তেল শিল্প, নারকেলজাত পণ্য- ছোবড়া শিল্প, মশার কয়েল ফ্যাক্টরি, কোকোডাস্ট এবং মালা শিল্পের ওপর। আর এই অবস্থা চলমান থাকলে বাড়তে পারে বেকারত্বের হার।


লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় ২ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে নারকেল বাগান রয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নারকেল গাছ রয়েছে। বাগান ও বাড়ি থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি শুকনো নারকেল আহরণ করা হয়। সে তুলনায়, প্রতি মাসে গড়ে ডাব বিক্রি হয় প্রায় দেড় কোটি পিস।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক ড. জাকির হোসেন জানান, "ডাব ও নারকেল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চাষীদের বছরে আয় প্রায় সাড়ে তিনশ থেকে প্রায় চারশত কোটি টাকা। ডাব বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার অতি মূল্যবান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে"।

শরীর ও ত্বকের যত্নে ডাব
কেবল আর্থিক ক্ষেত্রেই নয়, স্বাস্থ্যেও ডাবের পানির জুড়ি মেলা ভার। আমাদের দেশে সামাজিকভাবে ধারণা করা হয়, ডাবের পানি নিয়মিত খেলে রোগবালাই কমে।

এছাড়াও ডাবের পানিতে থাকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি। যা সানবার্ন বা রোদে পোড়া দাগ দূর করতে সাহায্য করে। অনেকে আবার ডাবের পানিকে ক্লিঞ্জার হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি যেমন ত্বকের ময়লা দূর করে তেমনি ব্রণ কমাতেও সাহায্য করে। ডাবের পানি ত্বকে উজ্জ্বলতা এনে দেয়। পাশাপাশি ত্বকের শুষ্কতা দূর করে ও আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনে।

কথায় আছে, ‍‍`জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা।‍‍` না, এখানে আমরা তেলের কথা বলবো না। চুলের যত্নে নারকেল তেলের যে কত উপকারিতা সেটা তো আমরা সবাই কমবেশি জানিই। কিন্তু, নিস্তেজ প্রাণহীন চুলে প্রাণ ফেরাতে যে ডাবের পানি অব্যর্থ, সেটি অনেকের কাছেই অজানা। ডাবের পানি মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন করতে সাহায্য করে; যা চুল পড়ার সমস্যা সমাধান করে। এটি চুলের ঘনত্ব বাড়ায় এবং ভাঙন রোধ করে চুলকে শক্তিশালী করে।  

আবার বসন্ত রোগ থেকে সেরে উঠলে অনেকেরই হাতে, মুখে দাগ হয়ে যায়। এই দাগের তীব্রতা কমাতেও ডাব সাহায্য করে।

স্বাদে আহ্লাদে ডাব
ডাব কিনতে গেলেই বিভিন্নজনের শুরু হয়ে যায় নানান রকম চাহিদা। কেউ বলেন ‍‍`কচি ডাব চাই‍‍`, কারো বা চাহিদা থাকে ‍‍`শাঁসওয়ালা‍‍` ডাবের। ডাবের পানির স্বাদ-গন্ধ যে অতুলনীয় সে কথা তো পূর্বেই বলা হয়েছে। রসনায় ডাবের ভূমিকাও কোনো অংশে কম যায় না।

ডাব নিয়ে শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় ‍‍`উদরপুরাণ এবং অন্যান্য বৈঠকি গল্প‍‍`য় লিখেছেন, এক বার হুগলিতে মোক্তার গুরুদাস বসুর বাড়িতে গিয়ে সুন্দর কচি ডাব দেখে তা খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। একটি ডাব কেটে তাঁকে পরিবেশন করা হলে রামমোহন বলেছিলেন, ‍‍`‍‍`ওতে আমার কী হবে? ওই কাঁদিসুদ্ধ ডাব পেড়ে ফেল।‍‍`‍‍`

ডাব নিয়ে হেঁশেলে উঁকি দিলে পাওয়া যাবে ডাবের পুডিং এর দেখা। ডিমের পুডিং তো হরহামেশাই পাওয়া যায় কিন্তু ডাবের পুডিং স্বাদে একেবারেই অনন্য। ডাবের পানি ও কচি শাঁসের সমন্বয়ে তৈরি হয় এই অমৃত খাবার।


আবার ধরা যাক, ডাব-চিংড়ির কথা। চিংড়ি মাছ যে ডাব দিয়ে রান্না করা যায়, তা বোধহয় কস্মিনকালেও কেউ ভাবেনি। কিন্তু ডাব ও চিংড়ির অপূর্ব মেলবন্ধন জিহ্বায় যে মনোহর স্বাদের উন্মেষ ঘটাবে, তার রেশ মনে থেকে যাবে বহুদিন।

ডাব চিংড়ি তৈরির জন্য প্রথমে গলদা চিংড়িকে বিভিন্ন মশলা, ডাবের পানি ও নারকেলের দুধ সমেত কারির মতো রান্না করতে হবে। পাশাপাশি প্রস্তুত করতে হবে ডাবকে; ডাবের মাথার অংশ কেটে ভিতর থেকে সব পানি আলাদা করে রাখতে হবে। এরপর চিংড়ির কারি ডাবের মধ্যে পুরে ডাবের মুখে আটা মাখা লাগিয়ে ডাবের কাটা টুকরো ঠেসে লাগিয়ে দিতে হবে। শেষে ডাবটিকে গরম পানির পাত্রের মধ্যে বসিয়ে ঢাকনা দিয়ে দিতে হবে। এভাবে ৪৫ মিনিট মাঝারি আঁচে রেখে রান্না করলেই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার ডাব-চিংড়ি।

ডাবের উৎপত্তি নিয়ে কিংবদন্তি!
ডাবের উৎপত্তি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা লোককথা প্রচলিত আছে। ভারতের কেরালার উপকথা অনুযায়ী ডাবের বা নারকেলের সৃষ্টি হয়েছে একজন জেলের কাটা মাথা থেকে। তাদের মতে, কেরালার একজন জেলে মাছ ধরার অনেক চেষ্টা করেও প্রতিবার ব্যর্থ হতেন। এই ব্যর্থতা তাকে সকলের কাছে হাসির পাত্র করে তুলেছিল। একসময় জেলেটি ঠিক করেন যে তিনি মাছ ধরার জন্য জাদু শিখবেন। যেই কথা সেই কাজ, একজন বিখ্যাত জাদুকরের কাছে যাওয়ার পর জেলে শেখেন একটি অদ্ভুত জাদু- তা হলো জীবিত অবস্থায় শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে মাছ ধরার জাদু।

জাদু শেখার পর জেলেটি পুনরায় সমুদ্র তীরে যান এবং ঝোপের আড়ালে থেকে অন্যান্য জেলেদের গতিবিধি লক্ষ করতে শুরু করেন। অন্যান্য জেলেরা মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবার পর শুরু হয় জেলের কাজ।

জাদুবলে নিজের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে জেলেটি মৃত মানুষের মতো সমুদ্রতটে ভাসতে শুরু করেন। জেলের লক্ষ্য ছিল একটাই- সমুদ্রের মাছেরা যখন মস্তকবিহীন শরীর পড়ে থাকতে দেখে যখন কৌতুহলের বশে ঘাড় দিয়ে শরীরে প্রবেশ করবে ,তখনই সে তীরে সাঁতার কেটে উঠে কাটা মাথা জোড়া লাগাবে। পরিকল্পনা অনুসারে জেলে সফল হলো এবং এভাবেই তার মাছ ধরার যাত্রা শুরু হলো।

মাছ ধরার জাল ছাড়াই জেলেকে প্রতিদিন এত এত মাছ ধরতে দেখে গ্রামবাসীর মনে সন্দেহ জাগে। কৌতূহলের বশে গ্রামের একটি ছোট ছেলে একদিন ঐ জেলেকে অনুসরণ করে। আড়াল থেকে দেখে তার কাজকর্ম। ছেলেটি যখন দেখে জেলে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে পানিতে ডুব দিয়েছে, তখনই সে কাটা মাথা নিয়ে এসে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। জেলেটি সমুদ্র থেকে উঠে এসে তন্ন তন্ন করে নিজের কাটা মাথা খুঁজতে শুরু করে কিন্তু আর খুঁজে পায় না। ততক্ষণে তার জাদুর ক্ষমতাও ফুরিয়ে যায়। শোনা যায়, জেলেটি তার মস্তকহীন শরীরকে সমুদ্রের কাছে বিলিয়ে দেয় এবং মাছে রূপান্তরিত হয়।

পরবর্তী সময়ে, ছোট ছেলেটি যখন আবার গ্রামবাসীকে জেলের কাটা মাথা দেখাতে যায়- তখন দেখে সেই মাথাটি একটি গাছের রূপ নিয়েছে এবং সেই গাছে জেলের মাথার ন্যায় ডাব ফলের জন্ম হয়েছে। কথিত আছে, ভারতের কেরালা বা কেরল প্রদেশের ‍‍`কের‍‍` নামও এসেছে নারকেল গাছ থেকে।  

ডাব বা নারকেলের উৎপত্তি নিয়ে চীনে-ও লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। নারকেল বা ডাবের চাইনিজ নাম এসেছে ইউ ওয়াং তু থেকে, যার অর্থ ‍‍`ইউ‍‍`- এর প্রধান রাজপুত্র।‍‍` একটি চীনা কিংবদন্তি অনুসারে, একদা রাজপুত্র লিন ই এর সাথে ইউ রাজ্যের রাজপুত্রের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে ইউ এর রাজপুত্র পরাজিত হন এবং তাকে হত্যা করে তার মাথা একটি গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। কথিত আছে, এই কাটা মাথাই পরবর্তী সময়ে ডাব বা নারকেলে রূপ নেয়।

ডাবের উৎপত্তি নিয়ে মালয়েশিয়ারও নিজস্ব লোককাহিনী আছে। তাদের কিংবদন্তি অনুযায়ী, অনেক বছর আগে হাজার বছর বয়সী একজন জ্ঞানী ঋষি বাস করতেন। একদিন এক যুবক বর প্রার্থনা করতে সেই ঋষির কাছে আসেন। যুবকটি প্রার্থনা করেন, তিনি সারাজীবন ভালো কাজ করতে চান এবং মানুষের সেবা করতে চান। এটি শুনে ঋষিটি যুবকের হাতে একটি জাদুর বাক্স ধরিয়ে দেন এবং বলেন, বাড়ি ফিরে যদি যুবক বাক্সটি খোলে তবেই তার ইচ্ছে পূরণ হবে।

যুবকটি বাক্স নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। কিন্তু পথিমধ্যে কৌতুহল সামলাতে না পেরে বাক্সটি খুলে দেখেন যুবক। আর তাতেই লাগে অভিশাপ, ঋষির কথা অমান্য করায় যুবকটি রূপান্তরিত হয় একটি ডাব গাছে। তবে মনে করা হয়, যুবকটির ইচ্ছেও পূরণ হয়েছিল। তিনি ডাব বা নারকেল হয়েই মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।

ভারতে ডাব বা নারকেলকে প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। এমনকি হিন্দু পুরান অনুসারে, ডাব গাছকে বলা হয় ‍‍`কল্পবৃক্ষ‍‍`। অর্থাৎ যে বৃক্ষ সবধরণের ইচ্ছে পূরণ করে; আরেক অর্থে যে বৃক্ষ জীবনধারণের সকল প্রয়োজন মেটায়। মালয়েশিয়াতে ডাব গাছকে বলা হয় ‍‍`পকক সেরিবু বুনা‍‍`। অর্থাৎ যে বৃক্ষ হাজারো রকমের কাজ করে থাকে। ইন্দোনেশিয়াতে ডাব গাছকে মনে করা হয় ‍‍`প্রাচুর্যের উৎস‍‍`। অপরদিকে, ফিলিপাইনে ডাব গাছকে বলা হয় ‍‍`জীবনের গাছ‍‍` বা ‍‍`স্বর্গের গাছ‍‍`।

সুমিষ্ট পানীয় জলের কারণে ডাবের চাহিদা আদতে কমার নয়, বরং দিন দিন তা বাড়ার সম্ভাবনা আছে। এই কারণেই প্রতি বছর ২ সেপ্টেম্বর পালিত হয় ‍‍`বিশ্ব ডাব দিবস‍‍`। মূলত ডাব নিয়ে জনমানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

আর্কাইভ