• ঢাকা শুক্রবার
    ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঙ্খাওয়ালাদের দেখা মেলে না

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২২, ১০:২৭ পিএম

পাঙ্খাওয়ালাদের দেখা মেলে না

“নিজেরে পুড়ায়ে ধূপ গন্ধ বিলায়’ এর মতো নিজে গরমের অস্বস্তিতে থেকে জীবিকার প্রয়োজনে বিরক্ত বদনে আদালতে পাখা টানছেন এক পাঙ্খাপুলার।

ফিচার ডেস্ক

গরমের যন্ত্রণা থেকে স্বস্তি পেতে এক সময় সরকারী অফিস আদালত বাংলো এবং ধনীদের আলয়ের সিলিংয়ে লাগানো হতো দড়িতে টানা পাখা। এই পাখা গুলো চালানোর জন্য পাঙ্খাপুলার নামের কর্মচারী থাকতো। 
আবার ঝুলানো পাখার পাশাপাশি হাটে বাজারে ফেরি করে বিক্রি হতো হাত পাখা। এই পাখার ছিলো নানা রুপ। বেশির ভাগ পাখা তালপাতার তৈরী। কেউ কেউ এই পাখায় ফুটিয়ে তুলতেন স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা। স্বামীর স্বস্তির জন্য কাপড়ের উপর ফুল তুলে তৈরী করতো কাপড়ের হাত পাখা। সেখানে লেখা হতো নানা কথা। কেউ লেখতো “ভূলনা আমায়”। কেউ আবার তাতে করতো ছড়ার চর্চ্চা। লেখা হতো “পাখা তুমি প্রাণের সখা শীতকালেতে দেওনা দেখা”। এছাড়া আরো কত কি যে লেখা হতো তা কেবল যারা দেখেছে তারাই জানে। 

এই পাখার অন্য রকম ব্যবহারও ছিলো। পড়া না পারা কিংবা কথা না শুনার জন্য বাবা কিংবা মায়ের হাতে পাখার হাতলের মাইর খাননি এমন লোক নেই বললেই চলে।
কালের বিবর্তনে এসেছে বৈদ্যুতিক পাখা ও এয়ারকণ্ডিশনার। এসবের আবির্ভাবে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই আমলের প্রায় সব ধরণের পাখা। ফুরিয়ে গেছে পাঙ্খাওয়ালাদের প্রয়োজন। বিলুপ্ত হয়ে গেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী পাখা এবং পাঙ্খাওয়ালারা।

আরও পড়ুনঃ পাড়া-মহল্লায় নেতা-কর্মীদের পাহারা দেয়ার নির্দেশ কাদেরের

 

পাঙ্খাওয়ালাদের সেই ঐতিহ্যবাহী পাখার প্রচলন শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে। ইংরেজরা এদেশে দলে দলে পাড়ি দিতে শুরু করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই।


পাঙ্খাওয়ালাদের সেই ঐতিহ্যবাহী পাখার প্রচলন শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে। ইংরেজরা এদেশে দলে দলে পাড়ি দিতে শুরু করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই। শুধু চাকরি নয়, বেনামে ব্যবসা ফেঁদে কাঁচাটাকা কামিয়ে তা দিয়ে আরাম-আয়েশ করার স্বপ্নে ভারতমুখো জাহাজে উঠে বসতেন তাঁরা। কিন্তু জন্ম থেকে ব্রিটেনের ঠান্ডা আবহাওয়ায় অভ্যস্ত ওই মানুষগুলো এদেশের প্রচন্ড গরমের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হামেশা নাকাল হতো। হাঁসফাঁস গরম থেকে রেহাই পেতে জানালা-দরজায় টাটি, খসখসে পর্দা অথবা চিক টাঙানো হতো। ঘরে চার বেলা পানি ছিটানো হতো। তালপাতার বড় বড় টানা পাখা নিয়ে বারান্দা বা দাওয়ায় মোতায়েন থাকত পাঙ্খাওয়ালারা। 

সেই সমস্ত পাখার হাতল ছিল প্রায় তিন-চার ফিট লম্বা। মাটিতে ভর দিয়ে তাকে খাড়া করা হতো। পাখার বেড়ে মখমলের ঝালর বসানো থাকত। সাহেবের কুর্সির পাশে দাঁড়িয়ে সেই পাখা দুলিয়ে বাতাস করত তালিম প্রাপ্ত নফর অর্থাৎ পাঙ্খাওয়ালারা। শুধুমাত্র তালগাছের পাতাই নয়, বাঁশের কঞ্চি, বাকল, ঘাস, বিভিন্ন রকম কাপড় এমনকি চামড়ার তৈরি পাখা ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার নানান দেশে ব্যবহার করা হতো। হাটুরে থেকে জমিদার, বামুনঠাকুর থেকে গাড়োয়ান- চিটমিটে গরমে প্রাণ জুড়োতে হাতপাখার বিকল্প ছিল না। ইতিহাস বলে, ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাখার প্রচলন হয়। মধ্যযুগে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা চালু ছিল।
হাতপাখার সাহায্যে যতটা হাওয়া বওয়ানো যায়, তার চেয়ে বড় জায়গা ঠান্ডা রাখতে ভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োজন দেখা দিল। ইতিহাস বলছে,  অষ্টম শতকে আরবে দড়িতে টানা পাখা ব্যবহার করা হতো। ভারতে তার আবির্ভাব হয় ইংরেজদের হাত ধরে। প্রচলিত মতে, গুমোট আবহাওয়ায় অনেকটা জায়গা জুড়ে হাওয়া খাওয়ার এই অভিনব কৌশল এদেশে প্রথম চালু করে পর্তুগিজরা। পরে তা অনুসরণ করে ইংরেজরা। ঐতিহাসিক এইচ ই বাস্টিড তাঁর Echoes From Old Calcutta (১৯০৮) বইয়ে লিখেছেন, কলকাতায় টানা পাখার আবির্ভাব হয় ১৭৮৪ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে। ১৭৮৩-৮৪ সালে জনৈকা সোফিয়া গোল্ডবর্নের চিঠিতে ভারতীয় পাখার উল্লেখ পাওয়া যায় বলে তিনি জানিয়েছেন। গোল্ডবর্ন দু’রকম পাখার কথা লিখেছিলেন। তাহলো- তালপাতার হাতপাখা এবং দড়িতে টানা আরেক ধরণের পাখা। যেগুলো ইংরেজ সাহেব-বিবিদের ঘরের সিলিং এ ঝুলত। তবে বাস্টিডের মতে, পর্তুগিজদের অবদানের ঢের আগে ভারতের মানুষ এই পাখার ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। 


সিলিং থেকে ঝোলানো পাখা লম্বায় ৮ ফিট, ১২ ফিট আবার কখনও ২০ বা ৩০ ফিটও হতো। হাল্কা কাঠ দিয়ে তৈরি হতো তার কাঠামো বা ফ্রেম। এর ওপর কাপড় অথবা নকশাদার কাগজ এবং পাখার নীচের অংশে বুনে দেওয়া হতো মসলিনের ঝালর। সিলিংয়ের ৩-৪টি হুক থেকে বাহারি দড়ির সাহায্যে তা ঝুলানো হতো। আর একটি লম্বা দড়ি পাখার শরীর থেকে বেরিয়ে মুখোমুখি দুই দেওয়ালে গাঁথা দু’টি পিতলের চাকার ওপর দিয়ে গিয়ে দেওয়ালের একটি গর্ত দিয়ে ঘরের বাইরে পৌঁছত। সেখানে দড়ির শেষ প্রান্তটি ধরা থাকত পাঙ্খাওয়ালাদের হাতে। মেঝের উপরে পা মুড়ে বসে সে ওই দড়ি ধরে বিশেষ ছন্দে টান দিত। মনিবের চাহিদা অনুযায়ী কখনও অতি দ্রুত দড়ি টানা হতো। আবার কখনও ফরমায়েশ মেনে ধীর লয়ে পাখা টানতো পাঙ্খাওয়ালা। অফিস-কাছারি-গির্জায় একাধিক টানাপাখার ব্যবস্থা থাকত। প্রতিটি পাখার দড়ি একগাছি মোটা দড়িতে এসে মিলত। তা ধরে টানলে একই সঙ্গে অনেকগুলি পাখা নড়াচড়া করে গোটা হলঘরে বাতাস সঞ্চার করত।
টানা পাখার হাওয়া কিন্তু সমান ভাবে ঘরের ভিতর খেলতো না। দড়ি টানলে পাখা সামনে এগোত, আবার পরমুহূর্তে দড়ি ছাড়লে তা নিজের ভারে দুলে পিছু হঠে যেত। আবার টেনে তা সামনে আনা হতো। এই রকমই ছিল পাখার চলন। ঘরের যে দেওয়ালের দিকে পাখা টানা হতো, সে দিকে হাওয়া জোরে বইতো। 
কোম্পানির সাহেব অথবা দেশি ধনীদের বাড়ির দুই অংশে পাখা টাঙানো হতো- খাওয়ার ঘর ছাড়া শোওয়ার ঘরে খাটের ওপরেও পাখা ঝুলতো। 

কলকাতায় নতুন পেশা ‍‍`পাঙ্খাপুলার‍‍`, দৃষ্টিহীনদের জন্য সুপারিশ নিয়ে গেল চিঠি  - Prohor

 

 বিভিন্ন ব্ইপত্র থেকে জানা যায়, আঠারো শতকে সারাদিন পাখা টানা বাবদ মাথাপিছু তিন আনা মাইনে পেত পাঙ্খাওয়ালা। রাতে কাজ করলেও একই হারে বেতন ধার্য করা হতো। অনেক সময় পাখা টানা ছাড়াও তাদের বাড়ি বা দপ্তরের বেশ কিছু ফুটফরমায়েশ খাটতে হতো।
১৯২৪ সালে লেখা ই এম ফর্স্টারের আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া উপন্যাসে পাঙ্খাওয়ালার বিবরণ মেলে।


শোনা যায়, এই কাজে বিশেষ কদর ছিল কানে খাটো মানুষের। বাড়ির নিভৃত কোণে তার উপস্থিতিতে পাছে গোপন কথা ও কীর্তি ফাঁস হয়ে যায়, সেই আশঙ্কাতেই বধিরদের জন্য এই চাকরি বাঁধা ছিল। আবার বংশ পরম্পরায় এই কাজে বহাল হওয়ার রীতিও ছিল।  বিভিন্ন ব্ইপত্র থেকে জানা যায়, আঠারো শতকে সারাদিন পাখা টানা বাবদ মাথাপিছু তিন আনা মাইনে পেত পাঙ্খাওয়ালা। রাতে কাজ করলেও একই হারে বেতন ধার্য করা হতো। অনেক সময় পাখা টানা ছাড়াও তাদের বাড়ি বা দপ্তরের বেশ কিছু ফুটফরমায়েশ খাটতে হতো।
১৯২৪ সালে লেখা ই এম ফর্স্টারের আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া উপন্যাসে পাঙ্খাওয়ালার বিবরণ মেলে। বইয়ের ২৪ নম্বর অধ্যায়ে ডক্টর আজিজের বিচার চলাকালীন আদালত কক্ষের বাইরে বসে দড়ি টানছে এক পাঙ্খাওয়ালা। তা দেখে উপন্যাসের নায়িকা মিস অ্যাডেলা কোয়েস্টেডের মনে দার্শনিক ভাবনা জেগে ওঠে। ভারতীয়দের প্রতি শাসক ইংরেজ শ্রেণির স্বভাবসুলভ বিরূপতা ছাপিয়ে সামান্য এক পরিচারকের মধ্যে এক অন্য ভারতকে যেন আবিষ্কার করেন অ্যাডেলা। পাখার দড়ি টানা সেই তরুণের বিবরণ দিতে গিয়ে ফর্স্টার তাকে জগন্নাথদেবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্যস্ত এজলাসের বাইরে বসে থাকা মানুষটির গায়ের রং ঘোর কালো। যন্ত্রের মতো সে পাখার দড়ি টেনে চলেছে। আদালতের উত্তেজনা তাকে স্পর্শ করছে না। তার চোখেমুখে লেপে রয়েছে এক ঐশ্বরিক নির্লিপ্ততা। 

কারা ছিল ঔপনিবেশিক ভারতের টানা পাখার পাঙ্খাওয়ালা! | The Business Standard

ঔপন্যাসিকের জবানে, ‘a perfect naked god’। শোনা যায়, ১৯১৩ সালে ঔরঙ্গাবাদ আদালত প্রাঙ্গণে দেখা এক নবীন পাঙ্খাবরদারকে দেখেই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ফর্স্টার। তবে তাকে চিনতে ভুল করেননি লেখক- জাগতিক বৈভবের মাঝে নিজের দারিদ্রের প্রকট উচ্চারণে আদতেই কোনও ভ্রূক্ষেপ করার ফুরসত মিলত না পাঙ্খাবরদারের। তার কাজ শুধু, সব ভুলে মনিবের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বাতাসের জোগান দেওয়া।
তবে বিত্তবান ছাড়া ঘরে পাখা টাঙানোর শৌখিনতা বজায় রাখা সেকালেও অসম্ভব ছিল। ১৮৭৯ সালে কলকাতায় প্রথম বিজলিবাতি জ্বালানো হয়। ১৮৯৯ সালে চালু হয় বৈদ্যুতিক পাখা। প্রযুক্তির মোক্ষম চালে টানাপাখার যুগের অবসান হয়। কাজ ফুরোয় পাঙ্খাওয়ালাদেরও।
 

 

সাজেদ/

আর্কাইভ