• ঢাকা মঙ্গলবার
    ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রাজিলে সহিংসতার নেপথ্য কারণ কি?

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৩, ০২:৫৩ এএম

ব্রাজিলে সহিংসতার নেপথ্য কারণ কি?

ক্রীড়া ডেস্ক

ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর হাজার হাজার সমর্থক দেশটির কংগ্রেস, পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে হামলা চালিয়েছে। ব্রাজিলের পতাকার রঙ উজ্জ্বল হলুদ ও সবুজ জামা পরে তারা গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের এসব ভবনে রবিবার ভাঙচুর করেছে। এরকম ঘটনা কেন ঘটছে?

বিবিসি জানিয়েছে, ব্রাজিলে ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে লড়াই হয় অতি-দক্ষিণপন্থী বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো এবং বামপন্থী লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা, যিনি লুলা নামেই বেশি পরিচিত, তাদের মধ্যে। তীব্র ও তিক্ত নির্বাচনী প্রচারণার পর ৩০শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফার ভোটে লুলা, যিনি ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, বলসোনারোকে সামান্য ব্যবধানে পরাজিত করেন।

কংগ্রেস ও পার্লামেন্টে হামলার ঘটনাকে লুলা “নজিরবিহীন” বলে উল্লেখ করে বলেছেন “গোঁড়া ফ্যাসিবাদীরা” এই হামলা চালিয়েছে। বলসোনারোর বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন লুলা। তিনি বলেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে দাঙ্গাকারীদের উস্কানি দিয়েছেন।“সবাই জানে সাবেক প্রেসিডেন্টের বেশ কিছু ভাষণ এই ঘটনায় ইন্ধন যুগিয়েছে,” বলেন তিনি।

ব্রাজিল গভীরভাবে বিভক্ত একটি দেশ। কংগ্রেসের ওপর হামলার ঘটনা নাটকীয়ভাবে প্রমাণ করেছে যে ব্রাজিলের মানুষ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণের জন্য কতো দূর পর্যন্ত যেতে পারে। তারা মনে করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর তাদেরকে প্রতিনিধিত্ব করছে না। এটা শুধু ডান ও বামের মধ্যে লড়াই নয়। এই ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যেসব মানুষ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করে, যখন ফলাফল তাদের আশানুরূপ না হয়, তখন তারা ব্রাজিলে গণতন্ত্রের প্রতীকগুলোর ওপর কেমন করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে।

যারা এই ভাঙচুরে অংশ নিয়েছে তারা একটি উগ্র ও ক্ষুদ্র একটি অংশ। কিন্তু তাদেরকে ছাড়াও আরো অনেকে আছেন যারা লুলার বিরোধী, যারা তার সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য রটিয়ে থাকেন, যার জের ধরে রবিবারের ঘটনাগুলো ঘটেছে।

লুলা দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। একসময় তিনি কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। ব্রাজিলে কেউ কেউ মনে করেন কারাগার থেকে তার প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে চলে আসা এক লজ্জাজনক ঘটনা। লুলা ২০১৭ সালে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ৫৮০ দিন কারাগারে ছিলেন। একারণে ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই নির্বাচনে জয়ী হন বলসোনারো।

পরে লুলার সাজা বাতিল ঘোষণা করা হয় এবং নির্বাচনে দাঁড়ানোর পথে যেসব বাঁধা ছিল সেগুলোও দূর হয়ে যায়। তবে লুলার অনেক সমালোচক মনে করেন ব্রাজিলের সর্বোচ্চ আদালত তার সাজা খারিজ করে দিলেও তার অর্থ এই নয় যে তিনি নির্দোষ ছিলেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে তার সাজা বাতিল হয়েছে। অন্যদিকে লুলার সমর্থকরা মনে করেন যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লুলার বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়েছে।

পরে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় দেয় যে এই মামলার বিচারক, যিনি পরে বলসোনারোর সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, নিরপেক্ষ ছিলেন না, তখন লুলার সমর্থকদের ধারণা আরো জোরালো হয়ে ওঠে।

জাইর বলসোনারোর অনেক সমর্থক তাকে একজন “ত্রাণকর্তা” হিসেবে বিবেচনা করেন। তাদের বক্তব্য মি. বলসোনারো তাদের “ঈশ্বর, পিতৃভূমি, পরিবার” এই মূল্যবোধকে রক্ষা করার জন্য কাজ করেছেন। তারা আশা করেছিলেন যে বলসোনারো লুলাকে পরাজিত করবেন। লুলাকে তারা তাদের মূল্যবোধের প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন। তার বিরুদ্ধে গুজব রটানো হয়েছে যে বামপন্থী এই নেতা একবার নির্বাচিত হলে সব গির্জা বন্ধ করে দেবেন। অনেকেই এই গুজব বিশ্বাস করেছে।

এই ভোটাররা মনে করেছিল যে লুলা হেরে যাবেন এবং তারা তার বিজয় চুপচাপ মেনে নিতে পারেনি। কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর ব্যারাকের সামনে অবস্থান নেয় এবং লুলার প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকানোর জন্য সামরিক বাহিনীর কাছে অনুরোধ জানায়। তারা বলেন এজন্য সামরিক অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হলেও তারা যেন সেটা করে। তবে সামরিক বাহিনী সেরকম কিছু করেনি। এবং পরিকল্পনা অনুসারে লুলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

লুলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে দাঙ্গা শুরু হয়। বলসোনারো, যিনি পরাজয় স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান, তিনি লুলার শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন নি, এর পরিবর্তে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এর ফলে যারা আশা করেছিলেন লুলার বিরুদ্ধে বলসোনারো জয়ী হবেন তাদের ক্ষোভ আরো তীব্র হতে থাকে। তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে লুলার দায়িত্ব গ্রহণকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ তারা লুলাকে “ব্রাজিলের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট হুমকি” হিসেবে বিবেচনা করে।

সামরিক বাহিনী যেহেতু তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি, তাই তারা বিষয়টিকে নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা এমন প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালায় যেগুলো তাদেরকে আর প্রতিনিধিত্ব করছে না বলে তারা মনে করে। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানকে তারা তাদের পছন্দের প্রতি হুমকি হিসেবেও বিবেচনা করে থাকে।

জাইর বলসোনারোর বিভেদ-সৃষ্টিকারী বক্তব্য এবং ব্রাজিলের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে তার তোলা প্রশ্ন, রবিবার যে ক্ষোভ দেখা গেছে, তাতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। নির্বাচনের আগে চালানো প্রচারণায় তিনি বারবার দাবি করেছিলেন যে ব্রাজিলের ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি জালিয়াতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে ব্রাজিলের অনেক মানুষই ভুলভাবে বিশ্বাস করে যে নির্বাচনের ফলাফল “চুরি” করা হয়েছে, যদিও নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলসোনারোর পার্টির করা চ্যালেঞ্জ নির্বাচনী আদালত খারিজ করে দিয়েছে।

দাঙ্গার পরে জাইর বলসোনারোর বিরুদ্ধে ব্রাসিলিয়ার দাঙ্গায় উস্কানি দেয়ার যেসব অভিযোগ এনেছেন প্রেসিডেন্ট লুলা, বলসোনারো টুইট-বার্তায় সেসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, “সরকারি ভবনে আজ যে লুটপাট এবং আক্রমণ চালানো হয়েছে” তা আইনের বাইরে। তবে যেসব চরমপন্থী দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে, তাদের লাগাম টেনে ধরা কঠিন হবে। সূত্র: বিবিসি।

আর্কাইভ